বাক্‌ ১৪৭ ।। রাহুল দাশগুপ্ত

 

প্রভু ৫

 

মিথ্যা সহ্য করতে না পেরে

গোটা দেশটা হতাশায় ভুগছে

ক্ষয়রোগ হয়েছে দেশটার।

লোকটি বলল। বিদেশি জানতে চাইলেন,

কেন এরকম হল?

লোকটি বলল, এদেশের প্রভুর জন্য

বুঝলেন, উনি সত্য সহ্য করতে পারেন না

সত্যকে ভয় পান

তাই সবসময় নিজেকে, নিজেদের মিথ্যা দিয়ে

আড়াল করতে চান

তিনি নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন

মিথ্যা তাঁকে স্বস্তি দেয়

গোটা দেশটাকে উনি মিথ্যায় ভরিয়ে দিয়েছেন

মিথ্যাকে করে তুলেছেন বৈধ

মানুষ এখন অনায়াসে মিথ্যা কথা বলে

কিন্তু বিবেকের দংশনে ভোগে না

বরং ভাবে, প্রভুই তো শিখিয়েছেন

উনি যদি বলতে পারেন

উনি যদি নিজের বিবেককে উপড়ে ফেলতে পারেন

আমরা নিজেদের বিবেক নিয়ে কী করব?

গোটা দেশটাকে এইভাবে, একটু একটু করে

তিনি ঠেলে দিয়েছেন অন্ধকারে...

তাহলে এত আলো কীসের? বিদেশি জানতে চাইলেন

কেন সবকিছু এত ঝা চকচকে? এ কী প্রহসন? 

লোকটি হাসল। তারপর বলল, ওগুলোও মিথ্যে

দেশটা তো ধুঁকছে

ওসব দেখালে প্রভুর চলবে কেন?

নিজের ছবি দিয়ে তিনি তাই দেশটাকে ঢেকে দিয়েছেন

আর ছড়িয়ে দিয়েছেন আলো,

সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছেন সব জায়গায়

যাতে আপনার মতো বিদেশিরা পচনের দুর্গন্ধ

আর এদেশের অন্ধকার চেহারা দেখতে না পান...

বিদেশি হতাশ হয়ে বললেন, দুর্ভাগ্য তোমাদের

প্রভু মিথ্যের কারবারি হলে

আলো আর আলো থাকে না

আড়াল হয়ে যায়...

 

 

প্রভু ৬

 

 

আসলে হয়েছিল যা...

প্রভু ছিটেফোঁটা দিয়েছিলেন দেশের মানুষকে

আর সিংহভাগ পেয়েছিল নিজের ছেলে

শত্রুর আক্রমণের খবর পেয়ে

তিনি ওই ছিটেফোঁটাই তুলে ধরলেন মানুষের চোখে

এদিকওদিক থেকে সেই ছিটেফোঁটার ওপর আলো ফেলে দেখালেন

মানুষের জন্য তিনি কত করেছেন

মানুষের তাঁকেই সমর্থন করা উচিত

শত্রুর আক্রমণের মুখে তাঁর পাশেই থাকা উচিত

প্রভুর ছেলে যা লুটপাট চালিয়েছিল

তাতে দেশের মানুষ ভিখিরি হয়ে গেছিল

তাই ওই ছিটেফোঁটা দেখেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল

নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি শুরু করল,

সত্যিই তো, প্রভু তো আমাদের জন্য অনেক করেছেন

ওই তো তার তালিকা, ওই তো ভুরি ভুরি উদাহরণ

কিন্তু একজন বিদেশি সেখানে উপস্থিত ছিলেন,

তিনি বললেন, গোটা দেশের জন্য প্রভু যা বরাদ্দ করেছেন

একা ছেলেকে তার কয়েকশো গুন দিয়েছেন

দেশের মানুষকে উনি একদম ভিখিরি বানিয়ে দিয়েছেন

আহা, আর একটু যদি দিতেন

দেশের মানুষ আর একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারত

ছেলেকে একটু কম দিলে কিছু ক্ষতি হতো না তাঁর

ছেলেটাও সংযত থাকত, এমন অমানুষ হয়ে যেত না

উনি দেশের ক্ষতি করলেন, আর ছেলের ক্ষতি করলেন তার চেয়েও বেশি

হ্যাঁ, দেশের প্রতি নির্মমতা দেখাতে গিয়ে

আর ছেলের জন্য অন্ধ লোভ করতে গিয়ে

শুধু সর্বনাশই হল, কারো উপকার হল না...

এখন সামান্যকে কত বড়ো করে দেখাতে হচ্ছে তাঁকে

চোখে ধুলো দিতে হচ্ছে দেশের মানুষের

দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেই চেয়েছিল

আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল তাঁকে

আর তিনি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করলেন...

প্রভু তখন নেংটি ইঁদুরকে দুহাত দিয়ে তুলে দেশের মানুষকে দেখাচ্ছিলেন

আর বলছিলেন, দ্যাখো, এই হাতিটিকে দ্যাখো

তিলতিল করে এই তোমাদের জন্যই না আমি বড়ো করে তুলেছি এই হাতিকে

হাতির কথায় অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল

তারা হাতিই দেখছিল

শুধু কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলছিল

হাতি কই? এ যে একটা নেংটি ইঁদুর

বছরের পর বছর ধরে খুঁজে পেতে এই দেশের জন্য

প্রভু স্রেফ একটা নেংটি ইঁদুর নিয়ে এসেছেন!

 

 

প্রভু ৭

 

অনেকগুলো খুন করার পর

প্রভু নৌকোয় উঠলেন

দূর থেকে হাহাকার ভেসে আসছিল

আগুন জ্বলছিল দাউ দাউ করে

আর রক্তে লাল হয়ে গেছিল নদীর জল

শাগরেদ বলল, প্রভু আপনার পোশাক

রক্তে লাল হয়ে আছে

প্রভু পোশাক খুলে উলঙ্গ হলেন

নদী পেরিয়ে নৌকো ততক্ষণে সাগরে এসে পৌঁছেছে

শাগরেদ বলল, প্রভু আপনার সারা শরীর

রক্তে ভেসে যাচ্ছে

প্রভু হেসে বললেন, ভাগ্যিস, ওগুলো আমার রক্ত নয়

শাগরেদ বলল, হ্যাঁ প্রভু, কতগুলো নিরীহ মানুষের রক্ত

যারা কোনও পাপ করেনি

তবু তাদের আপনি হত্যা করেছেন

শুধু সন্ত্রাস জাগাবেন বলে, যাতে তারা নির্ভুলভাবে

চিনতে পারে, আপনিই প্রভু, একমাত্র আপনিই...

প্রভু হাসলেন তারপর হুশ করে ঝাপ দিলেন সমুদ্রের জলে

অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলেন, তারপর নৌকোয় উঠে

শাগরেদের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর মতো হাসলেন,

যেন বলতে চাইলেন, এবার?

প্রভু এবার একটা শুভ্র বস্ত্র পরে নিলেন

তারপর শাগরেদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,

চিনতে পারছ আমায়?

শাগরেদ বলল, মুখটাই সমস্যা হয়েছে, প্রভু

ওটা এখনও একটা খুনির মুখ

ওই মুখে রক্তের ছাপ

প্রভু দাড়ি রাখতে শুরু করলেন

সাদা দাড়িতে ঢেকে গেল তাঁর সারা মুখ

তিনি এসে পৌঁছলেন একটা নতুন দ্বীপে

মাটিতে পা রাখার আগে দেখে নিলেন

তাঁর ছোরাটা আগের মতোই ধারালো আছে কিনা

দেশের লোক ততক্ষণে জেনে গেছে

ঈশ্বরপ্রেরিত এক সন্ন্যাসী এসে পৌঁছেছেন

তিনি পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করেন

তাঁকে দেখলেই মনে শ্রদ্ধাভক্তি জাগে

তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছা হয়

প্রভু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেন

তৈরি করলেন নিজের আশ্রম

দলে দলে লোক আসতে শুরু করল সেখানে

তাঁর চরণামৃত পাওয়ার আশায়

শাগরেদ বলল, আগের দ্বীপের লোকেরা ঠিক একই ভুল করেছিল

তারাও আপনাকে চিনতে পারেনি

এভাবেই পুজো করেছিল

আশ্চর্য ক্ষমতা আপনার

আপনি যে খুনি, তা চেনাই যায় না

আপনি যে গণহত্যাকারী, তা চেনাই যায় না

আপনি যে নরখাদক, তা চেনাই যায় না

পোশাক থেকে

শরীর থেকে

মুখ থেকে

রক্তের সমস্ত দাগ মুছে ফেলতে পারেন আপনি

নিরীহ, নিষ্পাপ মানুষের রক্তের দাগ

প্রভু হাসলেন

শাগরেদ বলে চলল, তবে একটা কথা ঠিক

আপনি প্রায় সবটাই পেরেছেন

শুধু আপনার আত্মার গায়ে যে রক্তের দাগ লেগে আছে

সেটা এখনও মুছতে পারেননি

প্রভু বললেন, কী করে বুঝলে?

শাগরেদ বলল, মাঝে মাঝে আমি পচনের গন্ধ পাই

আত্মায় অনেকদিন ধরে রক্ত জমে থাকলে

জায়গাটা পচে যায়

সেই জায়গায় ক্ষত তৈরি হয়

প্রভু হো হো করে হেসে উঠলেন

তারপর বললেন, আত্মা? কোথায় আত্মা?

তুমি নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন দেখেছ

আমার কোনও আত্মা নেই

আমার কোনও বিবেক নেই

প্রভুদের ওসব থাকে না

ওসব মানুষের থাকে

আর কখনও আমার কাছে আত্মার কথা বলতে এসো না

শাগরেদ অবাক হয়ে প্রভুর দিকে তাকিয়ে রইল

প্রভু যে মানুষ নন, শুধুই প্রভু

একথা সে জানত না, তাই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল...

 

 

প্রভু ৮

 

শুভবোধসম্পন্ন মানুষেরা যখন ক্রমেই কমে যায়

শব্দেরা আর শব্দ থাকে না

আবর্জনা হয়ে যায়...

 

গ্রামের মানুষ প্রভুর কাছে গিয়ে বলল,

প্রভু আপনি চুরি করুন

আপনি ডাকাতি করুন

আমাদের সর্বস্ব নিয়ে নিন

 

তবু আপনাকে আমরা আমাদের প্রভু বলেই ডাকব

আপনি আমাদের চোখ রাঙাবেন

চাবুক মারবেন

আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবেন

 

দম্ভে, অহংকারে, লোভে, মিথ্যাচারে

দুর্নীতি আর অপরাধে

অন্যায়ে আর অত্যাচারে

 

আপনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন

আপনি আমাদের প্রভু

আপনি গুলি করবেন, রক্তাক্ত করবেন

ক্ষতবিক্ষত করবেন

 

আর আপনার সামনে গিয়ে আমরা

নতজানু হয়ে দাঁড়াব

আপনাকে আশীর্বাদ করব

শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করব...

 

প্রভু সামান্য বিব্রত হয়ে

সামনের দিকে তাকান

অন্তত একজন মানুষকে খোঁজেন

যার শুভবুদ্ধি রয়েছে

 

কিন্তু তেমন কেউই ছিল না

প্রভুর চোখ কঠিন হয়ে আসে

তিনি কর্কশ স্বরে নিষ্ঠুরভাবে

চিৎকার করতে থাকেন

 

প্রভুর চিৎকারে কোনও শব্দ নেই

শুধু নোংরা আবর্জনা

প্রভুর চারদিক থেকে জয়ধ্বনি ওঠে

তাতেও কোনও শব্দ নেই, শুধু আবর্জনা

 

না, কারো মধ্যে সামান্য ঘৃণা নেই

রাগ বা আক্রোশ নেই

বঞ্চনার অপমান নেই

সুবিচারের আর্তি নেই

 

প্রভু তাদের নিংড়ে নিয়েছেন

তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন

তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছেন

তাদের বিবেক বা সৌন্দর্যবোধ, কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই

 

তবু তারাই প্রভুর জয়ধ্বনি দিতে থাকে

প্রভুর দিকে এগিয়ে যায়

হাতে জয়মাল্য নিয়ে

যেন শয়তান নয়, কোনও দেবতাই দাঁড়িয়ে আছেন...


No comments:

Post a Comment