৫
নিবারণ ও দিগম্বর দেখেছিল চরিত্রবান জলজ মেঘ গাছের মাথায়
ফেঁসে গিয়ে হাঁসফাঁস করছিল। তারপরে সেই মেঘকে মুক্ত করতে চলে এল আরও মেঘ, আষাঢ়ের
শেষের মেঘ কামনা বর্জন করে গর্ভবতী হয়েছে। এই সব গর্ভবতী মেঘ আঁতুড় ঘর খুঁজছে। মাঠ
তখন জাদু ডিঙ্গোচ্ছে, মেঘ হলুদ কালো ধনেশ হচ্ছে। কখনও সজারু। কখনও আবার শূন্যে ডিঙ্গি হয়ে ভাসছে। আবার কখনো কৈলাসের মহদেব। রসুল
এসেছিল দেওয়ান বাড়ির দালান থেকে সোজা মাঠে। আস্তাবলের ঘোড়ার ঘাস জাবড়া নিতে।
দিগম্বর দেখছিল আর হাসছিল, রসুল চেল্লাচ্ছিল,...
পাকা কাঁঠাল তোমার
ফুলের মতো গন্ধের রোয়া
এই ধেনেশ
এই ফিঙ্গে
এই সজারু
এই মানুষ
আঙ্গুল নিজের দিকে রাখো
তুমি ডিঙ্গি হয়ে গেছ...
প্রথমে
ফোঁটা ফোঁটা। বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি লাগাতার মাটি ভেজানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়, তারপরে লাগাতার।
বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই, যেন অতীত থেকে বর্তমান বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ জুড়ে
বৃষ্টি পড়েই যাবে।
এক বেদে এসেছিল। সে ছিল বদ্যি বেদে। মানুষের শরীরের ব্যথা
বেদনার উপশমের জন্য, কাঁধে ধনেশ পাখি নিয়ে ঘুরে বেড়াত। পাখির কথার মধ্য দিয়ে সে
তুলে আনতে চেষ্টা করত, মানুষের মনের গভীর কথা। বৈশাখের শুরুতেই তার পাখি বলে
গেছিল, এবার আসতে চলেছে ভয়ানক বন্যা। বৈশাখের আকাশের শুরুতেই এমন বার্তা আছে।
ধনেশপাখির কথা মিথ্যে হয় নি। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ভেসে গেল কলাবাগান, কলাগাছের
ভেলা অন্য এক ভেলামঙ্গল কাব্য লিখছে বন্যার জলের ছায়া। বেলঘর পারবাসুদেবপুর সেনের
আড়া নিমতা ফিঙে জলের গভীরে তলিয়ে গেল। সাহেবদের কতকগুলি ফিটন ভেসে গেল। তাঁবুর
উচ্ছেদ হল। জলডুব গাছের মাথায় জোনাকির উজ্জ্বল চাদর দূরের নক্ষত্রকে সংবাদ দিচ্ছে,
ভেসে আছি আমরাও জলের মহাশূন্যে। জোনাকির আলো পড়ে থাকা জলের ওপরে বড়ই অসহায়,
মানুষজন রাতে ভেলার ওপরে লন্ঠনের আলোর সংসার বসিয়েছে। পঞ্চনন্দ বড়ঠাকুরের
মন্দিরটিকে দেখে মনে হচ্ছে মাটির গভীরে গেঁথে গিয়ে, শুধু মাথার টোপরটি ওপরে অসহায়
তুলে ধরে রেখছে। নির্মীয়মাণ রেলপথটি উধাও হয়ে গেছে। পাহাড়ের মতো তুলে রাখা মাটি
প্লাবন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, গ্রামজীবন জলে ভেসে ভেসে সংসার করে যাচ্ছে। বন্যার জলের
ওপরে রান্না শোক পেতেছে যেন। উনুনের আগুন ডিঙ্গি ও ভেলার ওপরে লকলকাচ্ছে। কুলি
যারা এসেছিল রেলপথ নির্মাণের কাজে ফিরে গেছে বজরায়। হাহা হাহা...আহা নাই নাই
ধানসিদ্ধর উনান, শস্যভাণ্ডার ডুবেছে, গাছের মাথায় পাঠশালা, পুঁথি খাতা গাছের ডালে
বাঁধা। শূকর শেয়াল বনবিড়াল হরিণ মোষ গরু ছাগল বন্যার জলে ফুলে ফেঁপে ভেসে চলেছে
উজানের টানে, চারদিকে তাকালে মনে হয় গভীর দক্ষিণের বনজঙ্গল জলের সঙ্গে ভেসে
গ্রামের মানুষকে বনবাস দেবে।
নিবারণ ভগভগির খোলের জন্য কদুগুলি ঘরে তুলছিল। নবদ্বীপ
থেকে আসবে অনাথরুদ্র। বায়না করে গেছে। কদুগুলি নিয়ে যাবে। এখানকার মতো কদু না কি
আর কোথাও ফলে না। নবদ্বীপ থেকে ডিঙ্গি নিয়ে একদল খলায় এসেছিল। নিবারণ জানতে
চেয়েছিল, অনাথরুদ্রকে তারা কেউ চেনে কি না ? খলার একজন বলেছিল, নবদ্বীপের একজনই
ভগভগির কাজ করে, সে ভগভগি বনিয়েই খ্যাত। যদি তার কথা হয় তা হলে তাকে চিনি। নিবারণ
বলেছিল,-- তার ভগভগির খোল প্রস্তুত আছে। নিয়ে
যায় যেন। তারা কথা দিল নিবারণকে ঠিক অনাথরুদ্রকে জানিয়ে দেবে।
কেশবনন্দন সংবাদ দিল, ফতুল্লাপুরের সেই দরবেশ যার বাসখানার
মখমলি সামিয়ানা আগুনে পুড়ে গেছিল, সেই দরবেশ আবার ফতুল্লাপুরে ফিরে এসেছে। রসুল
জেনে গেছে ভারি বৃষ্টি ও প্লাবনের পরে তার বাবাজানের কবরখানার কিছুই হয় নি। সকালে গিয়ে
দেখে এসছে কবরের ওপরে জলের নুড়ির স্তূপাকার। গিরগিটি
বসে থেকে রঙ বদলাচ্ছে। জলাশয়ে নতুন জল, নতুন মাটি, আবার নতুন আস্তরণ, গ্রামবাসীর
জীবনে নতুন প্রলেপ, বন্যার পরে তল্লাটে আবার সব কিছু নতুন শব্দের বাদ্যি।
চারদিকে তাকালে সব কিছুকেই নতুন তালপাখার মতো লাগছে দেখতে।
বাড়ি বাড়ি ল্যাপাপোছার কাজ চলছে। দেদার খোলসে মাছের পিঠ জলের গভীরতাকে বর্ণময় করে
তুলেছে। তল্লাটের সবাই এটা সেটা বন্দক দিয়ে গ্রামে ও গ্রামের বাইরের হাটে গিয়ে
গবাদি কিনে আনছে। বন্যায় গ্রামজীবন ধুয়ে
মুছে দেওয়ার পরেও বাকি যা সামান্য ছিল চিল শকুনের মতো ঠ্যাঙ্গাড়ের দল, লুট করে
নিয়ে যাচ্ছে। নিবারণকে দিগম্বর বলল,- জনসন সাহেবের ঘোড়াটির মৃত্যুর পরে, এই
বিপর্যয়।
নিবারণ তা শুনে বলেছিল,-- কি হাস্যকর তুমি বলছ, প্রাকৃতিক
বিপর্যয়কে তুমি একটি ঘোড়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করছ।
দিগম্বর বেইলি সাহেবের কাছারিখানায় ফিরে যাবে। এই কথাটি
সেরে ফেলতে চাইছে নিবারণের সঙ্গে। সেই কবে এসেছে, এখনও
ফিরে যাওয়া হয়নি। যদিও বেইলি সাহেব বারে বারে খোঁজ নিয়ে জানতে চেয়েছেন বন্যায়
তাদের বাড়িঘরের স্থিতি কেমন আছে ? দিগম্বর সেই উত্তর জানানোর জন্য আকুল হয়ে আছে।
ভাবছে এ তার ভীষণ অনুচিত কাজ হয়েছে।
বেইলি সাহেবর থেকে উপহারে পাওয়া সেগুন গাছের চারাটিকে অনেক
ঝক্কি ঝামেলার পরে রক্ষা করা গেছে। নিবারণ এবং দিগম্বর অনেক চিন্তা করে ভেবেছে
সেগুন গাছটি সামান্য উচ্চতা পেলেই, বিশেষ একটি শুকনো স্থান দেখে, সহজে জল যাতে জমে
না, সেই স্থানে পুঁতে দিতে হবে। তারা ঠিক করেছে দেওয়ানদের বাড়ির সামনে দিয়ে নতুন
যে মাটির প্রশস্ত দাগের মতো ভেসে উঠছে, এই পথটিই আগামী ভবিষ্যতে বেলঘরের মধ্য দিয়ে
যাবে রেল স্টেশনের দিকে।
রেলগাড়ি তারা চোখে দেখেনি। কিন্তু জনসন সাহেব দিগম্বরকে
জোহানেসবার্গের একটি রেলগাড়ির ছবি দেখিয়েছে। সে ভারি চমৎকার। সেগুন গাছটি দেওয়ানদের বাড়ির সামনে প্রতিষ্ঠা করলে, বহু
রেলযাত্রী যারা স্টেশনের দিকে যাবে, শীতল ছায়া পাবে। পথের ওপরে একটি সেগুন গাছ
থাকলে সেই পথ ধনী হয়। ছায়াস্নিগ্ধতার সেই অর্থে কোনো নাম হয় না। বন্যার জল নতুন
মাটি এনেছে। গ্রামজুড়ে নতুন গাছগাছালির আসর বসবে।
মানচিত্রের খসড়ার কাজ একাই সাহেব করে যাচ্ছেন। তিনি একাই
তার কাছারির কাজের সব কিছু সামলাচ্ছেন। দিগম্বরের মন আর মানছে না। নিবারণ বারে
বারে আপত্তি তুলে বলল,-- আবার তা হলে যাওয়া কেন দিগম্বর ? আমি বলি কি তুমি বেইলি
সাহেবকে জানিয়ে দাও। জানি তুমি যে কাজটি করো সম্মানের ও মর্যাদার। সব কাজে তো
সম্মান পাওয়া যায় না। এইবার যাওয়ার জন্য তোমাকে বাঁধা দিব না, এইবার উপস্থিতি দিয়ে
পাকাপাকি ভাবে ফিরে এস। চাষের কাজ। লাঙ্গল বানানোর কাজটা একা হাতে আর পেরে উঠছি
না। একা মানুষ আমি, ঘর দুয়ারে মনটা হু হু করে ওঠে। লাঙ্গল, আগড়, মই গড়ার কাজের
প্রচুর বায়না, কিন্তু একা হাতে আর সম্ভব নয়। বুকের ভিতরে ফিঙে উড়ে এসে বসে,
উপলব্ধি করতে পারি নে দিগম্বর।
দিগম্বর দাদার যুক্তিকে অবহেলা করে নি। যথাযথ আদর জানিয়ে
বলেছে, কাজের সঙ্গে মানুষের মনের গভীরতর একটা সম্পর্ক থাকে। আমার তোমার কাজের
ক্ষেত্রেও তাই আছে। আমি মানচিত্রের কাজ করি, তুমি লাঙ্গলের কাজ করো। আমি তো তোমার
সঙ্গেই আছি।
তা হলে এমন একটা চুক্তি করে এস, প্রতিদিন কাজে যাবে আর কাজের
পরে বাড়িতে ফিরে আসবে।
সেই চুক্তিতে সাহেব রাজি হবে না।
হবে না আমি জানি। কারণ কি জানো, ওরা আমাদের দিয়ে ঘর কাছারি
গড়িয়ে নিল, কাজ করল নিজেদের শাসনের জন্য। কেউ
কোথাও স্থায়ী থাকে না। একদিন দেখবে ওরা এইদব ফেলে দিয়ে চলে যাবে। কারণ আমরা আমাদের
দেশের অধিকার ছেড়ে দেব না। অধিকারের জন্য চারদিকে স্বাধীনতার সংগ্রাম গড়ে উঠছে
বুঝতে পারছ না ? তোমার এই ছোটো মাথা বুঝবে না। হ্যাঁ, চারদিকে তাকিয়ে দেখ ওই গাছ,
ওই আকাশ, ওই বিল খাল ঝিল সব আমাদের গ্রামের। আমি এখানে পাখির ছদ্মবেশেও থাকতে
পারি, আমি নিসর্গের মায়া হতে পারি আর গ্রামের কৃষক যা কিছু। কেউ বাইরে থেকে এসে
আমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তা কেন হবে দিগম্বর ?
কেন তা করবে সত্যি তো ? আমাদের গ্রামের কর্তাবাবুরা
মাতব্বর সকল, সেই একই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
দেশের বাইরে হোক বা নিজের দেশ গ্রামের নিয়ন্ত্রণ করার
অধিকার কারও নেই। সবার নিজের স্বাধীনতার প্রতি তার অধিকার আছে।
নিবারণ ভগভগির কদুর খোলগুলি ঘরের ভিতরে গুছিয়ে রেখে বাইরে
এল। দিগম্বরকে বলে গেল ভোগের আগে গোয়াল মন্দিরে ধুনো দিতে, আজকে একবার ওইদিকটা
ভারি টানছে।
দিগম্বর বলল,-- বেশি দেরি করবে না। কোথায় যাবে ?
একবার ঘুরে আসি দেঁতের খালের ওই দিকটায়।
ভাবছি দেঁতের খালের ওই দিকে একবার যাব। অনেকদিন গলসের চক
চক দেখি নি। একবার দেখে আসি। পুঁটি এখন জলের মধ্যে আলোতে রূপার রঙ নিচ্ছে।
তুমি কথার মধ্যে কিছু একটা আড়াল করছ। গলসের চকচক পিঠ, এ বড়
দেখার তাই না ?
এখন তুমি এই কথা বললে, কথার পিঠে অনেক কথা হবে। বিকেল
গড়িয়ে যাবে।
বড় সুন্দর দেখার উপাদান ছড়িয়ে রেখেছেন তিনি। চারদিকে ছড়ানো
জলজ ঘাস, আর বৈভবের রঙ মহাশূন্য জুড়ে। মেঘ এসেছে, গলার মালা হচ্ছে, বাজপাখির
চঞ্চুর মতো ধারালো, আকাশ ঘর পেতেছে, বিবরণে মহাভক্তি এনেছে। নিবারণ বিস্ময়ে তাকিয়ে
আছে, মেঘ আকাশের ভাষা বুঝতে চাইছে। মেঘের মধ্য থেকে উৎসারিত লাগাতার ছবির মিছিল।
মাঝে মাঝে মেঘের ঘর্ষণে শব্দ নরম। নিবারণ যেন আবার দেখতে পাচ্ছে একজোড়া খড়ম পা,
কালো মেঘের গ্রাম অতিক্রম করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মহাশূন্য থেকে নেমে আসছে, তার দিকে। নিবারণের মনে হচ্ছে এরপরে ঘটে যাবে
পরের পর ঘটনাগুলি। সেইদিন যেমন ঘটেছিল।
“আমাকে অনুসরণ করো নিবারণ”
নিবারণ ঠিক সেইদিনের মতো আবার চমকে উঠল। একই ভাবে ঘটে যাবে,
সেই সেইদিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। আহ্বান আর অনুসরণের নির্দেশ। নাড়িকুড়ি জঙ্গলের
দিকে তাকে টেনে নিয়ে যাবে অনুসরণের আহ্বান। নদীকূলের কাছে পড়ে থাকবে অচেতন। নিবারণ
পরের পর সেইদিনের ঘটনাগুলিকে মনে করতে থাকল। হ্যাঁ, আবার সেই একইভাবে তাকে ডাকছে
পিতৃদেব,-- “আমাকে অনুসরণ করো নিবারণ”...
আমার অনুসরণে কোনো ত্রুটি ?
লাঙ্গল মাটি কর্ষণ করে। লাঙ্গলের আকার প্রকারের মধ্যে
অধ্যয়ন আছে নিবারণ। সেই অধ্যয়নে আরও মন দাও নিবারণ। লাঙ্গলের আকার ও প্রকারের দিকে
গভীর মনোনিবেশ করো। কৃষি সরঞ্জাম তীক্ষ্ণ হলে, ভালো কৃষিকর্ম হয়। কৃষিকর্ম ভালো
হলে, দেশের উৎসব পার্বণ আচার ভালো হয়। এই মোহময় জগতের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক
না থাকলেও ধানের মাঠে শরীর পেতে দিয়ে আরাম শয্যায় আছি। কৃষিকর্ম ও লাঙ্গলবিদ্যা
জানা অজানার সব পড়ে আছে ধানমাঠে। কুড়িয়ে নাও নিবারণ। একটা ভক্তি ভক্তি গন্ধ পাচ্ছ
নিবারণ ?
ধান সিদ্ধ হচ্ছে। সেই গন্ধ পাচ্ছেন।
“আমাকে অনুসরণ করো নিবারণ”
নিবারণ দেখতে পারছে মেঘ নেমে এসেছে জমির কাছে। সম্পূর্ণ
শরীর অদৃশ্য। শুধু পা দুইটি তাকে অনুসরণের
নামে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যেতে যেতে নিবারণ চেতনা হারিয়ে ফেলছে। সে বুঝতে
পারছে বাতাসে ভেসে ওঠা গাছের পাতা, শকুনের গায়ের গন্ধ, ভাঙ্গা মাটির পাত্রের
টুকরো, ছেঁড়া ফাঁদিজাল, পাড় ভাঙ্গা ডিঙ্গি,- দৃশ্যগুলি ও গন্ধগুলি তাকে বিবশ করে
দিচ্ছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে সে পুনরায় এগিয়ে যেতে থাকল সেই নাড়িকুড়ি গ্রামের
জঙ্গলের দিকে.........
দেঁতের খালের ধারে ছড়িয়ে থাকা, ছেঁড়া ছেঁড়া জলাশয়ের মধ্যে
কাদা মাটি থেকে যা পেরেছে, শুকনা ঝুড়িতে ভরে নিয়ে চলেছে নাড়িকুড়ির দিকে। গলসে বাইন
পুঁটি ল্যাটা শোল মাছের পোনা ঝুড়িতে পড়ে আছে, সাথে কিছু শালুকের ডাঁটা সিদ্ধ করে
নুন ছড়িয়ে দিলে, পোড়া মাছের সঙ্গে বাহ্। দেঁতের খালের পাড় ধরে, পূর্বদিকে এগিয়ে
যাচ্ছিল শুকনা। মাথায় তুলে রাখা ঝুড়ি থেকে আঁশটে জল
গড়িয়ে পড়ছিল শুকনার গালে শরীরে। কয়েকটা জিয়ল ঝুড়ির ভিতরে তখনও দাপড়াচ্ছে। মাছ
দাপড়ালে ডানা ছটফটানোর মতো শব্দ হয়। ফাঁকা মাঠের ওপরে, সেই শব্দের প্রতিধ্বনি ও
কম্পন উদরের ভিতরে ক্ষুধা চাগিয়ে তোলে। ঘরে ফেরার পড়ে উনান ও আগুনের আয়োজনের কথা
ভাবছিল শুকনা। এই স্থানে বড়ই নির্জনতা তলিয়ে থাকে। দিঘির জলের ঘাইয়ের শব্দকে ভৌতিক মনে হয়। প্রথমে বুঝতে পারে নি শুকনা, দূর
থেকে মনে হচ্ছিল, কাপড়ের স্তুপ পড়ে আছে। সাদা কাপড়ের স্তুপ যেমন, যত কাছে এগিয়ে
যাচ্ছিল, স্তূপের আকার অনেকটা সাদা শুয়ে আছে মরার মতো। শুকনার পা ভারি হয়ে আসছিল।
এগিয়ে যাচ্ছিল আবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। যাবে কি যাবে না, অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পরে,
আঁশটে মাছের ঝুড়ি মাটিতে নামিয়ে, স্থির দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিল, মনের গভীরে
ভৌতিক এক ভৌতিক স্পর্শ পাচ্ছিল। পারবাসুদেবপুর থেকে নিমতা পর্যন্ত জলাশয় আতিপাতি
করে সন্ধান চালিয়ে যা আঁশটে তুলেছে এমন তো দেখে নি। শুকনা সাহস করে এগিয়ে যেতেই
চিনতে পেরে শিউরে উঠল। নিজের মনেই বিস্ময়ে বলে উঠল...
নিবারণ ঠাকুর !!! নিবারণ ঠাকুর !!!
নিবারণ শুকনাকে দেখে আচ্ছন্নতা কাটিয়ে, উঠে বসল।
আপনে এইখানে ?
বাতাসের গন্ধে, মাঠের গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গেছিলাম।
দাঁড়ান। আমি একটু জল নিয়ে আসি। আমার কাছে পালি আছে।
চোখমুখে একটু জলের ছিটা দেন। চোখে অন্ধকার
লাগলে কমে যাবে ঠাকুর। একটু জলের ছিটা দেন।
নিবারণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,-- তুই যা, আমি চলে যাচ্ছি। তুই
যা।
আমি একটু জল এনে দিই, আপনে চোখেমুখে দিয়ে নেন।
তুই যা, আমি নিজেই দিয়ে নিচ্ছি।
শুরুতে যেভাবে মেঘ এল, আমি আটকে গেলাম। যতটা না কাহিনী, তার থেকে ভাষা, উপমার সরস বর্ণনায় আবেশ এল, নতুন উপলদ্ধি হলো। আপনার আরও লেখা পড়ার প্রত্যাশায়
ReplyDelete