নগরের একুশ পুতুল
'পেছনে যে দাঁড়ালো তাকে দিও আলো
পাশে যে মুখ তাকে দিও
নিঃশ্বাস জোনাকির
যে থাকে মুখোমুখি তাকে দিও
বিশ্বাস প্রথম পাখির'
দু' হাতের
তালুতে শুয়ে থাকা বোতলের একুশ শব্দ চেয়ে আছে অতনুর দিকে। ঠিক ওর মায়ের চোখের
মতোন। বিবাহ বুঝিবা অক্ষর বুকে যেমন একটি বই; কখনো থমকে দেয়
ভুল বানান, কখনো ভীষণ প্রিয়। অতনুর মা প্রিয় সংসারে
চেয়েছিলেন একটু যাদু আলো, একটুখানি উড়াল বিশ্বাস। না
পেয়ে পেয়ে বুঝি মানুষটার শেকড় আলগা হয়েছিল, তাই অমন আগুন
পাখি হয়ে উড়ে যেতে পেরেছিলেন। অতনুর মা- যার মতোন কখনো কেউ হতে চায়নি, ছেলেমেয়েরাও নয়। তবে তিনি ছিলেন ওরকমই। পেয়ালায় সাজানো ফল থেকে বেছে
নিতেন সবথেকে ছোট কিংবা খারাপটা। ঈশ্বর যদি 'বেছে নাও জীবন'ও বলতেন মা এই জীবনই নিতেন যে জীবন আর কেউ চায় না, ফেলনা
ভাবে, যার মতো কখনো কেউ হতে চায় না।
মানিয়ে যাওয়ায় অভ্যস্ত
মায়ের চলে যাওয়ার মানে অতনু আজও ঠিক বুঝে না। হয়তো অবলীলায় মা নিয়তিকেই মেনে
নিয়েছিলেন। তবে পড়শী বোতলদের দিকে তাকালে মনে হয় মায়ের বেঁচে থাকার চেষ্টা
ছিল। অমন সুন্দর একেকটা কাচের বোতল। কিছু বাবার পানশালা থেকে ফুরিয়ে যাওয়া
গোত্রের, আর সব মায়ের কেনা, কখনো গয়না বেঁচেও। অতনুর এখনও
মনে পড়ে সোনার গয়না বেঁচে ছাইপাশ কেনে জানাজানি যেদিন হলো, বাবা ভীষণ রেগে গিয়ে দরজা বন্ধ করে মাকে মেরেছিল। বাবা হয়তো রেগে
গিয়েছিল মায়ের না-নতজানু উত্তর শুনে- "যখন দিয়েছিলে, ভেবেছিলাম এগুলো আমার নিজের। শর্ত জুড়ে দিয়ে উপহার হয় না, ভাড়া হয়।"
মায়া পড়ে যাওয়ার মতোন
মায়ের লেখা চিরকুট বোতলে এমনভাবে রাখা বাইরে থেকে অনায়াসে পড়া যায়। মাকে ময়না
তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো, অতনু তখনও মায়ের না থাকার হুহুতে ধাতস্থ হয়নি।
মা যে বরাবরই থেকেও ছিল না থাকার হাওয়ায়। রাতে অতনু 'ক্ষিধে
পেয়েছে' সহজ সত্য জানান দিয়েছে, গরম
নুডুলসে ফুঁ দিতে দিতে তাফসীর চাচাকে জিঞ্জেস করেছে 'ময়না
কেন বলে?' তাফসীরও গুমোট কাটাতে কথা ছড়িয়েছে, 'ময়না পাখি খুব কালো, তেরো রকমের ডাকও ডাকতে জানে।
সেজন্য অন্ধকারে ময়না পাখি খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে অভিজ্ঞ লোক ডাক শুনে চিনতে
পারে ওটা ময়না। অন্ধকারে ময়না চেনার মতোই ওরা মৃত্যুর রহস্য খুঁজে।' অবশ্য পরে অতনু জেনেছিল ময়না ফার্সি বা উর্দু শব্দ, যার অর্থই ভালো করে খোঁজা। অনেক পরে অতনু জেনেছিল কিভাবে শরীর কেটে ছিঁড়ে
হয় হুহু ময়নার সন্ধান। তবে কখনো কি খুঁজে পায় মানুষ পাখিদের উড়বার ম্যাপ?
অতনুর মা যখন লাশ কাটা ঘরে, 'ওই মহিলা আমার
জীবনটাকে বাকসো বানিয়ে দিয়েছে, দ্যাট ওমেন, দ্যাট ক্রেজি ওমেন'- চিৎকার ছুঁড়তে ছুঁড়তে
চিলেকোঠায় জলদস্যুর মতোন অতনুর টালমাটাল বাবা সাত সিন্দুকের বোতলগুলো মেঝেতে
ছড়িয়েছিল। যেমন উলঙ্গ হয় আকাশের তারা, তেমন হয়েছিল:
'আকাশ এক রিফিউজি ক্যাম্প'...
'ঘুমগুলো সব কোথায় যায়
আলোর ছাতায়, আকাশ
পাড়ায়,
রোগকাতুরে মুখের ভাঁজে- একটা
জন্ম যমুনা থাকে?
বয়াম ছেড়ে যে চিনিরা আদিম
পাতায় হারিয়ে গেছে?
ঘুমগুলো সব কোথায় যায়
অন্য কারো পাশবালিশে?
হারিয়ে ফেলা ময়ূর বোতাম
কিংবা কোন অন্তর্বাসে?'
স্পার্টান যোদ্ধারা মায়ের
ট্রয় নগরী গুড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন। আর প্রতারিত রাতে অতনু ভেবেছিল সমুদ্রে
ভাসিয়ে দিক এইসব বোতল। সেই বোতল মানুষের মতোন, বাইশ বছরে দশ হাজার চিরকুট বোতলে ভরে
সমুদ্রে ভাসিয়েছিল যে। অবশ্য একদিন- পাঁচ হাজার ডলার জরিমানা- জেনেই হয়তো তাকে
থেমে যেতে হয়। অথবা তাকে ভাবিয়েছিল খ্রিস জর্ডানের তোলা ছবির সেইসব মৃত, শুকিয়ে যাওয়া অ্যালবাট্রস পাখি যাদের পাকস্থলীতে আটকে ছিল ভাসন্ত
প্লাস্টিক, বোতলের মুখ। অজস্র বোতল শরীরে নিয়ে, মা যেন ছিল সেই করুণ অ্যালবাট্রস। অথবা অ্যালবাট্রস অতনু নিজেই। তাই সমুদ্র
নয়, অতনু পেয়েছে বোতলের উত্তরাধিকার। অতনু এক ছোট্ট ছেলের
গল্প পড়েছিল যার ঘরভর্তি ছিল বয়াম, সেখানে রাখা ছিল ছেলের
প্রিয় সবকিছু- হেমন্তের বিকেল, ঢেউ, তারা
ভরা রাত, সমুদ্রের শব্দ, সূর্যাস্তের
লাল রং, প্রথম তুষার...
অতনুও আরশি নগরে বোতল নিয়ে
সংসার করে, বিকেলে লুকিয়ে প্রতিবেশী বারান্দার মুখোমুখি হয়। সেখানে ফুটফুটে ছোট
মেয়ে ভালোবাসে তার ছোট্ট বাগান, নিয়ম করে গাছে জল দেয়,
শুকনো পাতা সরায়, ঝুলানো বাটারফ্লাই ফিডারে
এক কি দুবার প্রজাপতি উড়ে বসলে রংধনু হয়। বাগানে আরও এক রমণী, তদারকি যতটা করে তার থেকেও তাকিয়ে থাকে অতনুর জানালার দিকে। অতনুর
তাকিয়ে থাকাটা ওদের অজানা। অস্তিত্ব রমণী কল্পনা করে- দু পক্ষেরই বড়ো বোনেরা 'দুজনকে বেশ মানায়' মতামত দিয়ে এঁকে গেছে কল্পনার
পথ। সে পথেই পড়শীর ঘরে আসে ওরা, ঘুরে ঘুরে সংসার দেখে,
নাম অতনু শুনে রমণী এমন হাসে যেন মুঠো বাদাম ভেঙে পড়ে, তারপর খোসার মতোন ছড়িয়ে যায় গুনগুন গান- 'কি বলব
পড়শীরও কথা/ হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাই রে'... সেই বাদাম ভাঙা
হাসি বালিশের পাশে পড়ে থাকা পর্ণ ম্যাগাজিন দেখেও সরে না, বরং
চোখ নাচায় 'যাক ঋষি নন। স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়া আছে।'
অতনুর এই ইচ্ছের উড়ান আমার
অজানা ছিল। লেখক বলেই চরিত্রের সবকিছু জেনে ফেলবার অধিকার আমি রাখি না। চরিত্র আমি
সৃষ্টি করি না,
কেবল বর্ণনা করি। বর্ণনার জন্য উপকরণ যোগাড় করতে গিয়েই দেখেছি
রমণী যখন বাদাম, ছোট মেয়ে তখন ছুঁয়ে যাচ্ছে মায়ের বোতল।
রমণী না থাকলে মেয়েকে অতনু হয়তো বোতলের গল্প বলতো। অবশ্য সে সুযোগ তৈরি হয়। ছোট
মেয়ে হয়ে ওঠে সাঁকো- সেখান দিয়ে যায় আসে সর্ষে ইলিশ, ত্রিফলা,
আট মোমবাতি, কচুরি, মোমরঙ,
দুপুর রোদ, রাঙা গোলাপ, নারকোল
পিঠে, কাহরিল জিবরান, মনোহরা, নতুন লাল সাইকেল শেখানো, নরম কেক, জলপট্টি, লাইব্রেরীতে হেঁটে যাওয়া, বাচ্চাদের বই, না পাওয়া শৈশব, দুর্বাসা ঈর্ষা। রমণীর চন্দনের বাকসে জমা হয় হিম ঘোর, খুনসুটি, নতুন রান্নাবাটি। আর ছোট মেয়ের গোপন
বয়ামে জমা হয় চকলেট, গাঁদা ফুলের চারা, হামিংবার্ড ফিডার, অনেক অনেক আদর, একুশটি গুয়েতমালান ওয়ারি ডলস। রাতে এক ইঞ্চি সমান পুতুলগুলোকে মনের
দুশ্চিন্তা-ভয় শুনিয়ে বালিশের নিচে রেখে দিলে, সকালে সব
চিন্তা নিয়ে নেয় পুতুল।
এ ভ্রমণে আমার ভূমিকা তখন
প্রতিবেশী বারান্দায় বসে থাকা লুঙ্গিপড়া অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধের মতোন। নিজের জীবনে
ঘটনার ঘনঘটা ফুরিয়ে যায় বলে পত্রিকা যার প্রিয় হয়, প্রিয় হয়
ঘটনাবহুল চারপাশের বারান্দাগুলো। একেকদিন অতনু ঘরে যাওয়ার অনুমতি দিলে আতস কাঁচের
নিচে দেখি- বাদাম চকোলেট, পাজল পিস, এক
আপেল ভাগাভাগি, দাবার গুটি, অতনুর বদলে
যাওয়া, বোতলের গল্প, অতনুর মা যিনি
শিখিয়েছিলেন কিভাবে বিশ্বাস দিতে হয়। এক কাপ চায়ের পর আবার ফিরে আসি বারান্দার
জীবনে। একদিন দেখি ছোট মেয়ে, যেন ক্রুদ্ধ দেবী লাইসা অথবা
ঘুর্ণিঝড়ের একরোখা চোখ, অবোধ্য ভাষায় চিৎকার করছে আর
ছুঁড়ে দিচ্ছে বামন টবগুলো অতনুর দরজার দিকে। পড়শীর দরজায় ভেঙে পড়ছে গরঠিকানার
তুমুল ঝড়, শিশুর প্রিয় বাগান- গার্ডেন জেরানিয়াম, প্রিন্সেস লিলি, মিশরীয় স্টারক্লাস্টার, রক্তজবা, কন্দ বেগোনিয়া, সাদা
কুন্দ, গুটি গুটি পোকা, অন্ধ কেঁচো,
কালো সব মাটি, দাগ, দাগ...
আর উথালপাথাল দুলে যাচ্ছে কানে কানে ঝড় শুনতে পাওয়া একুশটা চিন্তা পুতুল।
No comments:
Post a Comment