বাক্‌ ১৪৭ ।। আবেশ কুমার দাস

 

 

ভোরবেলার স্বপ্নেরা

 

কেবিনে ডেকে খবরটা দিয়ে ডানহাতটা সবে অমিতাভর দিকে বাড়িয়েছিল সেকশনাল ম্যানেজার। পাতলা হয়ে আসা ঘুমটা ভেঙে গেল তখনই। শীত আর ঘোর বর্ষা বাদে মাথার লাগোয়া জানলাটা খোলাই থাকে রাতবিরেতে। ঘরটা বুকচাপ। তাতে যা গুমোট পড়েছে ক’দিন। শরৎ চলছে যে, কে বলবে।

          জানলা দিয়ে সকালের ত্যারচা রোদটা এসে পড়ছে মুখে। ঘুম ভেঙেছে তাতেই। পাশ ফিরে আর-একবার চোখদুটোকে বোজার চেষ্টা করে অমিতাভ। যদিও তাতে কি আর ফিরে আসে ছিঁড়ে যাওয়া স্বপ্ন!

          না, এবারে উঠতেই হবে। ঘাড়ের কাছে তেতে উঠছে সকালের রোদ। বারান্দা থেকেও ভেসে এল পরিচিত আওয়াজটা। পুবের জানলাটার কপাট শেষ কবে বন্ধ করেছিল মনে পড়ে নারোজ সকালে লাগোয়া সরু গলিটা ধরে এসে খবরের কাগজখানাকে গরাদের এদিকে চালান করে যায় বাসু।

          কাজের মাসি এসে পড়বে এখনই। সে-ই এসে প্রথমে চা করে দেয়। সকালের দিকে বাজারহাটের পাটটা ইচ্ছে করেই আর রাখেনি অমিতাভ। স্টেশন লাগোয়া জর্জ রোড আর ক্যানিংহাম রোড জুড়ে টাটকা বাজার বসে ফি সন্ধ্যায়। অফিসফেরতা অমন সুযোগটা থাকতে সক্কাল সক্কাল ঝঞ্ঝাটের মধ্যে কে আর যেতে চায়! বরং এই ভাল। চা খেতে খেতে বারান্দায় বসে সওয়া আটটা অবধি কাগজখানায় চোখ বুলিয়ে ধীরেসুস্থে স্নানে ঢোকে অমিতাভ। মাথায় জল ঢালতে ঢালতেই ওদিকে ঘরদোর ঝেড়েমুছে, বাসন মেজে অল্প রান্নাবান্না হয়ে যায় মাসির। এই মহিলার ভরসাতেই রোজ ন’টা দশের লোকালটা ধরতে পারছে সে। মাসে মাসে টাকাটা তাই একটু বেশি গুনতে হলেও গা করে না। মিষ্টি বেশি চাইলে গুড় তো ঢালতেই হবে খানিক। আর একা মানুষের অত বাঁচিয়ে হবেটাই বা কী!

          রবিবার বা ছুটিছাটার দিনগুলোয় সামান্য হেরফের বাদ দিলে বছর পঁয়তাল্লিশের অমিতাভর জীবনটা বেশ নিস্তরঙ্গই। আত্মীয়স্বজন বিশেষ নেই কেউ। দূর সম্পর্কের যারা আছে তারাও দূরেই থাকতে চায়। অফিসের বাইরে বন্ধুবান্ধবও নেই বিশেষ। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র অতনুর সঙ্গেই যা কালেভদ্রে দেখা হয়ে যায় রাস্তাঘাটে। অফিস থেকে ফিরে পাড়ার লাইব্রেরির বই নিয়েই কেটে যায় সন্ধেটা। মাঝে একফাঁক ফুটিয়ে নেয় দুটো ডালসেদ্ধ-আলুসেদ্ধ।

চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে আজ কিন্তু একটু আনমনা হয়ে গেল অমিতাভ। গরাদের ফাঁকে শরতের একটুকরো আকাশে পরিযায়ী মেঘ। ভোরের অসমাপ্ত স্বপ্নটুকুকে মনে পড়ে গেল আবার। অফিসে বসের সুনজরে পড়তে, প্রোমোশন পেতে কে না চায়! সে-ও চায় তেমনই। আবার অনেকদিন থেকেই আটকে রয়েছে একটা জায়গাতেই। যদিও তা নিয়ে খুব একটা মনঃকষ্টও নেই। আচ্ছা, ভোরবেলার স্বপ্নেরা নাকি সত্যি হয়! অনেককেই বলতে শুনেছে বটে কথাটা। মনে পড়তেই আপনা-আপনিই একটু হাসি খেলে যায় ঠোঁটের কোনায়।

এত দূর! তার স্বপ্নবিলাস এত দূর বেড়ে উঠেছে! অমিতাভর মনে হয় একটা সামান্য স্বপ্ন নিয়ে এমন আকাশপাতাল তার মতো লোকেই হয়তো ভাবতে পারে। গরাদের ফাঁকে ফাঁকে তখন শরতের মনকেমন আকাশ। মনে মনে একচোট হেসে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে অমিতাভ ভাবতে থাকে কারা যে রটায় এসব! তার নিজের কথাটা প্রথম শোনা স্কুলজীবনের বন্ধু সৌরেন্দুর কাছে।

অনেকদিন পর আজ হঠাৎ মনে পড়ল সৌরেন্দুকে। ক্লাস টুয়েলভ অবধি সে আর সৌরেন্দু ছিল বলতে গেলে মানিকজোড়। একসঙ্গে একই বেঞ্চিতে রোজ পাশাপাশি বসেছে। তপনবাবু, সুভাষবাবুদের ক্লাসে একসঙ্গে গোলমাল করেছে। সমীরবাবু ছাত্রদের দিকে পেছন ফিরে বোর্ডে অঙ্ক করাতে শুরু করলেই সারা ক্লাসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘হুলো হুলো’ বলে চেঁচিয়েও উঠেছে একসঙ্গেই। শুধু সৌরেন্দু! সুপ্রকাশ, রাকেশ, দেবব্রত, গৌরব, সরু অমিত, অতনু— সেই ইলেভেন-টুয়েলভের গোটা ব্যাচটার কথাই মনে পড়ে যায় নিমেষে এখন। একটা ছোট্ট শেষ না-হওয়া স্বপ্নের সূত্রে সৌরেন্দুকে মনে পড়তেই। পাশাপাশি ছিল দুটো স্কুল— নরেন্দ্র বিদ্যানিকেতন আর কাত্যায়নী গার্লস। প্রায় বছর আঠাশ আগে এমনই এক শরতের ভোরে এই নরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের তৎকালীন ক্লাস ইলেভেনের এক উজ্জ্বল ছাত্র অমিতাভ দাস তার শেষ না-হওয়া স্বপ্নে কাত্যায়নী গার্লসের ইলেভেনের ছাত্রী সঞ্চিতা দাসকে দেখতে পেয়েছিল। সেদিনই ক্লাসে গিয়ে কথাটা সে আর প্রাণের বন্ধু সৌরেন্দু মুখার্জিকে ‘বলব না বলব না’ করেও না বলে থাকতে পারেনি। সৌরেন্দু অমিতাভর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিল, জিয়ো অমি জিয়ো। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় জানিস তো? সে কী, জানতিস না! ওকে, ইটস দ্য ফ্যাক্ট। তোর ওই স্বপ্নসুন্দরী সঞ্চিতাই তোর জীবনসঙ্গিনী হচ্ছে তাহলে। আমি তোর এই স্বপ্নদোষের কথাটা নবনীতা, শাশ্বতীদের জানানোর ব্যবস্থা করি তাহলে? ঘটকালি করতে হবে তো...

শুনেই আঁতকে উঠেছিল অমিতাভ।

আজ সেদিনের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমে নিজের অজান্তেই একবার মৃদু হেসে ওঠে অমিতাভ। সত্যি, কী পাজির পাঝাড়াই না ছিল সৌরেন্দুটা! তারপরই কী মনে পড়তে ক্ষণকাল উদাস হয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার চিলতে হাসির রেখা খেলে যায় ঠোঁটের কোনায়। তার জীবনের সেই প্রথম ভোরের স্বপ্নকে ঘিরে বন্ধুর করা সেই ভবিষ্যদ্‌বাণীকে মনে করে...

আচ্ছা, সৌরেন্দু নিজে কি বিশ্বাস করত এই কথাটায়? নাকি নিছক মজা করেই সেদিন বলেছিল কথাটা? কে জানে! অমিতাভর মনে পড়তে থাকে কেমন চনমনে প্রাণময় ছেলে ছিল সেই সৌরেন্দু। ফরসা, লম্বা, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, সুন্দর স্বাস্থ্যের সৌরেন্দুর সেই হাসিখুশি মুখটা চোখ বুজতেই আজও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল অমিতাভ। শুধু তাই নয়, মনে মনে একটুখানি ভাবার চেষ্টা করতেই সৌরেন্দুর কণ্ঠস্বরটুকুও যেন অবিকল বেজে উঠল কানের পর্দায়। সেই আঠাশ বছরের পরপার থেকে।

স্কুল ছাড়ার পর ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় পুজোর বাজার করতে গিয়ে মাত্র আর-একবারই দেখা হয়েছিল সৌরেন্দুর সঙ্গে। সেদিনও শরতের আকাশে এসে জমেছিল এমনই একপশলা পরিযায়ী মেঘ।

পুরনো আমলের ঘড়িটার ঘণ্টায় ঘা পড়তেই অমিতাভর সংবিৎ ফেরে। সাড়ে আটটা বাজল। হাতের কাগজটা মুড়ে চটপট উঠে পড়ে। এখনই স্নানে ঢুকতে হবে। এই রে, আনমনে গালে হাত বোলাতে গিয়েই মনে পড়েছে। দাড়ি কামাতে হত আজ। দোনোমনো করেও গালে সাবান লাগিয়েই ফেলল অমিতাভ। পলকেই নরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের সেই বন্ধুদের গ্রুপ বা কাত্যায়নী গার্লসের সেই ডাকসাইটে সুন্দরী সঞ্চিতার স্মৃতি আবার হারিয়ে যায় আঠাশ বছরের প্রহেলিকার পরপারে।

ডাল-ভাত আর সদ্য-রাঁধা মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া সেরে যখন সদরে তালা লাগাচ্ছে অমিতাভ, তখন আর ভোরবেলার স্বপ্নের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই মনে। সেই দেরি হয়েই গেল আজ। আর পেলে হয় ন’টা দশ।

অফিসে কাজের বাইরে কিছু মাথায় ছিল না সারাদিনে। পুজোর আগে আগে চাপ থাকে সব জায়গাতেই। ফেরার পথে আজ কেনাকাটাও ছিল না বিশেষ। ক’টা ডিম আর সামান্য আনাজপাতি নিয়ে ক্যানিংহাম রোডের মোড় ঘুরে সবে কয়েক পা এগিয়েছিল মানিক সাধুখাঁ লেনের দিকে। নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে গোড়ায় ঠাহরই করেনি মুখোমুখি এসে পড়া লোকটাকে। কিন্তু আজব কারখানা বটে মানুষের মগজ। যা কিছু তলিয়েও যায় কবেকার বিস্মৃতির অতলে, তাদেরও এক-একটা প্রতিচ্ছবি বোধহয় ধরাই থাকে ধূসর কোষে কোষে আজীবন। এমনকি সুদীর্ঘ সময়ের প্রতিক্রিয়ায় কতখানি বদলে যেতে পারে সেই কবেকার পরিচিত ছবি, তারও মোটামুটি একটা সমীকরণ সম্ভবত ছকা থাকে অজান্তেই। যেন তাই ছাব্বিশ বছর পরও সামান্য ইন্ধনেই জ্বলে ওঠে স্মৃতি। কী মনে হতে মানিক সাধুখাঁ লেনের আলোছায়া ফুঁড়ে হেঁটে আসা লোকটার দিকে দ্বিতীয়বার তাকিয়েছিল অমিতাভ। এবং গলা ঠেলে পরক্ষণেই বেরিয়ে এল, আরে, সৌরেন্দু না!

সৌরেন্দু এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক তার মুখোমুখি।

যাক, চিনতে পেরেছিস তাহলে! দিব্যি তো বেরিয়ে যাচ্ছিলি গটগট করে। আসলে কে আর মনে রাখে বল আমাদের...

সৌরেন্দুর গলায় অবিকল সেই ছাব্বিশ বছর আগের কণ্ঠস্বর। হঠাৎ মনে হয় অমিতাভর, চেহারা একেবারে বদলে গেলেও গলার আওয়াজটা বোধহয় একই রয়ে যায় বরাবর। তবে স্রেফ চেহারাতেও বেশ চেনা যায় সৌরেন্দুকে। যেটুকু পরিবর্তন এতগুলো বছরের ব্যবধানে হওয়ারই কথা, যেন ঠিক সেটুকু বদলই হয়েছে তার। বা যেন ততটাও নয়। মুখের সেই চৌকোনা আদলটা, চোখের সেই প্রাণবন্ত চাহনিটা, এমনকি ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি উপচে পড়া সেই হাসিটাও যেন ঠিক তেমনই রয়ে গিয়েছে অবিকল। এমনকি ওই চশমার ফ্রেমটাও যেন ঠিক আজকের কেতার নয়। আবছা আলোছায়ায় ভাল করে ঠাহর করতে না পারলেও মনে হল অমিতাভর— যেন ঠিক এই ফ্রেমখানাই অত বছর আগেও ব্যবহার করত সৌরেন্দু। তাকে এবার কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে ভাল করে নজর করতে গিয়ে অমিতাভর মনে হয় যেন কী এক ইন্দ্রজালে সৌরেন্দু রয়ে গিয়েছে সেই পুরনো দিনগুলোর মতোই অবিকল। তেমনই হাসিখুশি, তেমনই সপ্রতিভ, তেমনই সম্ভাবনাময়। আর আজকের সৌরেন্দুর সঙ্গে সেদিনের সৌরেন্দুর এত মিল খুঁজে পেতে পেতেই অমিতাভ যেন সকালের মতোই আবার হারিয়ে যায় মেদুর অতীতচারিতায়। আর কী আশ্চর্য, কত কত বছরের সেই ভুলে যাওয়া কত কত কথারা টাটকা টাটকা মনে পড়তে থাকে যেন ঠিক গতকালের ঘটনার মতোই।

হ্যাঁরে, স্কুলে থাকতে তোর সেই যে প্যারাসাইকোলজি না একটা কী নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল না? সেই যে বলতিস বড় হয়ে ওটা নিয়ে পড়বি। তারপর যেমন-তেমন নয়, একদম পাগলের ডাক্তার হয়ে বসবি। মনে পড়ে সেসব কথা?

অমিতাভর গলায় নস্টালজিক অধীরতা।

আলবাত, সৌরেন্দু বলতে থাকে, ওটাই তো আমার আজকের প্রফেশন রে...

নিজের কৈশোরের স্বপ্নকে যে শেষ অবধি সৌরেন্দু সফল করতে পেরেছে, জেনে ভাল লাগে অমিতাভর। তার নিজের জীবনে যেভাবে ডাহা মিথ্যে হয়ে গিয়েছে ভোরবেলার স্বপ্নেরা...

সৌরেন্দু বলে যায়, আমরা মানুষের মনে থেকে যাই কেন জানিস তো? কেননা, মানুষের মনটাকে নিয়েই কারবার আমাদের। এই নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে করতেই বুঝলি, টেরটিও পেলাম না, কোথা দিয়ে ফুরিয়ে গেল সময়। আর কী যে অদ্ভুত এই মানুষের মন...

মানিক সাধুখাঁ লেনের মুখটা কেমন ছায়া ছায়া অন্ধকারময়। গলির ভেতর বাতিটা জ্বলেনি আজহাওয়ায় কেমন অদ্ভুত শিরশিরানি। ক’দিনের সেই গুমোট ভাবটা সারাবেলার মধ্যে কখন সরে গিয়েছে আবহ ছেড়ে। সৌরেন্দু দাঁড়িয়েছিল অমিতাভর সামনেই। কিন্তু তার কথাগুলো যেন সেই শিরশিরে হাওয়ায় পাক খেতে খেতে কোন সুদূর থেকে বয়ে আসছিল অমিতাভর কানের পর্দায়। বাজছিলও কী এক অদ্ভুত মনকেমনের সুরে। সদ্য আজ সকালেই সৌরেন্দুকে মনে পড়া থেকে অফিসফেরতা পথে ছাব্বিশ বছর পর আবার আজই আচমকা তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া— সবটা মিলেমিশে কেমন স্বপ্নাবিষ্টের মতো লাগছিল অমিতাভর। সৌরেন্দুর কথার সবটাই যে সে বুঝছিল তা নয়। তবুও কী এক দুর্নিবার টানে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল কথাগুলো।

সৌরেন্দু বলছিল, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা যে কী গাঢ় ছাপ ফেলে যায় মনের নরম পর্দায়। এক-একটা মানুষের সমস্যা দেখতাম আর ভাবতাম। যদি পারতাম সবার জীবনের সব অঙ্ক একেবারে মিলিয়ে দিতে...

অনেকক্ষণ থেকেই শুধু শুনছিল অমিতাভএতক্ষণে একটা কথা বলে, তা কি আর হয় ভাই? আমাদের জীবনেরই বা ক’টা অঙ্ক মিলল শেষ অবধি...

সে-ইতবে তো ঈশ্বরই হয়ে যেতাম। তবে বলতে পারিস, ভাবছিলাম অনেকদিন থেকেই। ঠিক ওষুধ বা কাউন্সেলিং নয়। কীভাবে একটা অন্য জাতের সমাধান দিয়ে যেতে পারব মানুষকে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল, একেবারে সব সমস্যার আগে, মানে হারানোরও আগে বরং যেদিন স্বপ্ন ছিল পাওয়ারই, কেমন হত যদি মানুষের মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম সেই শুরুর মুহূর্তটায়...

অমিতাভ ঠিক বুঝতে পারে না সৌরেন্দুর শেষের কথাগুলো।

যেন তার মুখের ভাব খেয়াল করেই এবারে বলে ওঠে সৌরেন্দু, দ্যাখ অমি, আজ এই বয়সে এসে তুই নিজেকে নিয়ে কী কী ভাবিস? সেই চাকরিতে প্রোমোশন, নয়তো রোগভোগতাই তো! অথচ ভেবে দ্যাখ, সেই একদিন কী ব্রাইট ছিল এই তোর স্বপ্নগুলোই...

সত্যি! আজকাল মনে করার চেষ্টা করে অমিতাভ। কবে থেকে বদলে গেল স্বপ্নগুলো! সেই যে বয়সটা ছিল একদিন। সঞ্চিতা আসত ভোরের স্বপ্নে। আবার কতদিন চুটিয়ে খেলা হত ক্রিকেট। কাত্যায়নীর পেছনের মাঠে সৌমেন, সৌরেন্দু, জয়ন্তদের সঙ্গে। লোকের মুখে মুখে কেমন করে যার নাম হয়ে গিয়েছিল দাদুর মাঠ। ওই বয়সে ওই মাঠকেই মনে হত লর্ডসের সমান কিছু। কতদিন পলাশের ওভারের সেকেন্ড বলটায় তুলে ছক্কা মেরেই আড়চোখে তাকিয়েছে কাত্যায়নীর নাইন এ-সেকশনের ঘরটার দিকে। ঠাহর করার চেষ্টা করেছে জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে কিনা। ওই ঘর থেকে সোজাসুজি দেখা যেত মাঠটাকে। নন-স্ট্রাইকার এন্ড থেকে তখন যুবনাশ্মর চিৎকার, আর চার বলে সাত অমি। ভোরের ঘুমটা ভেঙে যেত কতদিন সেই চিৎকারেই। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মনে হত কতদিন। আজই স্কুলে গিয়ে বলতে হবে যুবটাকে, ষাঁড়ের মতো চেল্লাসনি তো আর...

সেখানে আজ কত বদলে গিয়েছে স্বপ্নগুলো!

সৌরেন্দু বলে, কেমন হত অমি, যদি সেই পুরনো স্বপ্নগুলোই এখন থেকে আবার দেখতে পেতিস তুই রোজ রোজ...

অমিতাভর মনে হল, তা কেমন করে সম্ভব! স্বপ্নগুলোও তো আসলে বদলেই যায় বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে মুখে বলে, আর কি সেই দাদুর মাঠে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখতে পাব! মাঠটাই যে নেই আর। প্লট করে বাড়ি হয়ে হয়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছে। জানিস না হয়তো। কাত্যায়নীর পেছনটা এক্কেবারে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে এখন...

রহস্যময় হেসে সৌরেন্দু বলে, জানি, সবটাই জানি। জানতে পেরেছি। একদম সদ্যই। আর বলতে পারিস এই জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেছে অনেকদিনের তালা আটকানো একটা দরজা। যার চাবিটা খুঁজছিলাম বহুকাল ধরেই। ওখানেই তো ম্যাজিক রে। যা কিছু আজ আর নেই, অথচ ছিল একদিন, মানুষকে আবার তার মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবতুই আমার এককালের বেস্ট ফ্রেন্ড। তোকে দিয়েই শুরু করব ম্যাজিকটা...

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল অমিতাভ। সৌরেন্দুর কথাগুলোর কিছু কিছু তাকে স্পর্শ করছিল। আবার কিছু কিছু ভেসে যাচ্ছিল তার অস্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে। সন্ধ্যার পর নেহাত কম লোকজন হাঁটে না জানমহম্মদ ঘাট রোডে। রিকশা চলে। সাইকেল যায়হাঁটতে হাঁটতে কানে ফোন ধরে কথা বলে মানুষ। পুবে রেললাইন থেকে পশ্চিমে গঙ্গার দিকে ধেয়ে চলা সেই রাস্তা থেকেই গোত্তা খেয়ে ডানহাতে ঢুকে পড়ে মানিক সাধুখাঁর নামের চিলতে গলিটা। জানমহম্মদ ঘাট রোডের গাড়িঘোড়ার কলরব দিব্যি অনুপ্রবেশ ঘটায় এই গলির অন্তরঙ্গেও। কিন্তু আজকের এই বাতি না-জ্বলা শরৎসন্ধ্যার পরিবেশে যেন কী ছিল। সেই দূর বহুদূর থেকে অনুরণিত হয়ে আসা সৌরেন্দুর রহস্যময় কথাগুলো অমিতাভকে যেন একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল ঘটমান বাস্তব থেকে।

সৌরেন্দু বলে যায়, আসলে কিছুই হারায় না রেপুরনো ভাললাগা-ভালবাসার সবটুকুই রয়ে যায় মানুষের অবচেতনেই। সমস্যা কী জানিস, একদিন জীবনকে নিয়ে যা-যা ভেবেছি আমরা, বাস্তবে ঘটেছে একেবারে উলটোটাই। বেঁচে থাকার তাগিদে মানিয়ে নিতে হয় সবাইকেই। আর এভাবে রোজ রোজ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতেই সচেতন মনটাকে একদিন বদলে ফেলি, হারিয়েই ফেলি আমরা। কিন্তু ভেতরের সেই ভাললাগা-ভালবাসাগুলোর তো আর কোনও দায় নেই এত মানিয়ে চলার। তারা তাই গোপনে বেঁচে থাকে তাদের মতোই। আর তাদের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে, বেঁচে আছে, বরাবর বেঁচেও থাকবে আমাদের নিজস্ব সত্তাটা। যে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়বে তোর চেতনা, তখনই ঘুম থেকে জেগে উঠবে তোর সেই অবচেতন...

শুনতে শুনতে কী এক ঘোরে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল অমিতাভ। তাই আচমকাই যখন সৌরেন্দু নিজের হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েই ‘আজ আসি ভাই, সময় হয়ে এল’ বলে পা বাড়ায় জানমহম্মদ ঘাট রোডের দিকে, তখনই কিছু বলতে পারেনি সে। পরক্ষণেই হুঁশ হতে প্রায় ছুটে বড়রাস্তার মুখে ফিরে এসেও আর কোনওদিকে টিকিটিও দেখতে পায় না সৌরেন্দুর। অথচ খুব বেশি ভিড়ও নেই জানমহম্মদ ঘাট রোডে। চারদিক আলোয় আলো। যেদিকেই যাক না কেন সৌরেন্দু, এর মধ্যে একেবারে চোখের আড়ালে চলে যাওয়া কি সম্ভব! ধাঁধা লেগে যায় অমিতাভর। হতভম্বর মতো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আবার পা বাড়ায় গলির ভেতর। অবাক লাগে...

বাড়ি ফিরতে ফিরতে হঠাৎই খেয়াল হয়, সৌরেন্দুর ঠিকানা বা ফোন নাম্বার কিছুই তো জানা হল না। অথচ এতক্ষণ কথা হল। এতদিন পর দেখা হতে এতটাই মশগুল হয়ে পড়েছিল। নিজের বেখেয়ালের জন্য মনে মনে আপশোশ হতে থাকে এখন। আর সৌরেন্দুটাও এমন! রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অতক্ষণ অত কথা বলে গেলি, কাজের কথাটা তো একবার মনে করে মানুষে! অত তাড়াহুড়োরই বা কী ছিল! আর দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে গেলে কী অসুবিধা হচ্ছিল!

আচ্ছা, এতদিন বাদে সৌরেন্দু হঠাৎ কেন এসেছিল এদিকে! তাও তো বলল না কিছুই। এদিকপানে কোনও আত্মীয়স্বজন কি থাকত ওর! মনে তো পড়ে না। ট্রেনে করে তন্ময়দের সঙ্গে আসত ছেলেটা। বাড়ি ছিল কাঁকিনাড়ার দিকে। যতদূর মনে পড়ে। ভাবতে ভাবতে ধাঁধা লেগে যায় কেমন। এত বছর পর হঠাৎ সৌরেন্দুর এদিকে আসা। এই এঁদোগলির আবছায়ায় দাঁড়িয়ে দু’জনের কথাবার্তা। সবটাই যেন অদ্ভুতুড়ে।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে অমিতাভ। সে রাতে আর মন বসে না লাইব্রেরির বইতে। ভাতের মধ্যে ডালের পুঁটলি আর ডিম ফেলে দ্যায় একটা। এক সময় শুয়েও পড়ে খেয়েদেয়ে। আর কী আশ্চর্য! ভোররাতের দিকে ঘুমটা তখন আবছা হয়ে এসেছে। হঠাৎ দেখতে পায় অমিতাভ...

সমীরবাবু নরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের তিনতলায় ইলেভেন এ-সেকশনের ঘরে অঙ্ক করাচ্ছেন বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ শেষের দিকের একটা বেঞ্চি থেকে অতনু, সরু অমিত, জয়ন্ত আর সুপ্রকাশ ‘হুলো হুলো’ বলে চেঁচিয়ে উঠল একযোগেভালমানুষ সমীরবাবু অঙ্ক করা থামিয়ে এগিয়ে এসে তাকে আর সৌরেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলেন যে কারা চেঁচাল। বাঁদিকের সারির ফার্স্ট বেঞ্চে দু’জনই ছিল তারা। যাক, দু’জনেই অম্লানবদনে জানাল যে তারা অঙ্ক দেখছিল বোর্ডে। পেছন থেকে কারা চেঁচিয়েছে খেয়াল করেনি। সমীরবাবু রেগেমেগে আবার বোর্ডে ফিরে গেলেন। ক্লাসভরতি ছেলের মুখে ফিচেল হাসি। ওপাশের সারির ফার্স্ট বেঞ্চে বসে তন্ময় সেন, তন্ময় কর্মকার, গৌতম আর দেবব্রত...

এই সময় অমিতাভর ঘুমটা ভেঙে যায়। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ধাতস্থ হতে সময় লাগে খানিক। পাতলা একটা আলসেমি যেহেতু আঁকড়ে থাকে তখনও শরীরটাকে। সেই ভাবটা ধীরে ধীরে মুছে মাথাটা এক সময় পরিষ্কার হয়। তখনই মনে পড়ে ভোরবেলার স্বপ্নটুকুর কথা। পরক্ষণেই বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে যায় গত সন্ধ্যার ঘটনাবলি। আশ্চর্য! ঠিক এমন কিছুরই কথা বলছিল না সৌরেন্দু...

কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত ভাবটা অন্তর্হিত হয়ে যায় মন থেকে। ঝকঝকে নীল আকাশে আজ সাদা মেঘের জলছবি। গরাদের ফাঁকে ফাঁকে ত্যারচা হয়ে এসে পড়ছে আঁচ গায়ে না-লাগা শরতের নরম রোদ। কোন বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলা— ‘দুই নয়ন ঘুমে মগন যখন, মোর ভুবনে শুধু স্বপন আবেশ বেলা ছায়...’

বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে একফাঁক দেয়াল ঘড়িটা দেখে নেয় অমিতাভ। আটটা পাঁচ। মনে মনে যুক্তি সাজাতে থাকে, সদ্য গতকালই ঠিক এই সময়ই ঘটনাচক্রে পুরনো অনেক কথাই মনে পড়ে গিয়েছিল। তারপর সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ এতদিন পর সৌরেন্দুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া। বাড়ি ফিরেও বহু কথাই ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়ার আগে অবধি। তাই...

ক’দিন পরই আবার যখন চেনা ছন্দে এসে পড়বে চিন্তাগুলো, এই ব্যতিক্রমী দিনটাকে তখন হয়তো আর মনেও থাকবে না

তবুও সৌরেন্দুর কথাগুলো আর তার নিজেরই দেখা ভোরের স্বপ্নটাকে অফিসে বসেও মাঝেমধ্যেই মনে পড়তে থাকে সারাদিন। খচখচিয়ে চলে একটা অস্বস্তির কাঁটা...

কিন্তু অমিতাভর বিস্মিত এমনকি বিমূঢ় হয়ে যেতে বাকি ছিল তখনও। তার জন্য অপেক্ষা করতে হল সন্ধ্যা অবধি। অফিসফেরতা বাজারের রাস্তায় আজ হঠাৎ অতনুর সঙ্গে দেখা। প্রায় মাসদেড়েক পর দেখা হল দু’জনে। দু’ তরফেই খানিক ‘আসতে পারিস তো একদিন বাড়িতে’ বা ‘তুইও তো একবার যেতে পারিস’ গোছের কথাবার্তার পর অতনু হঠাৎ বলল, শুনেছিস নাকি খবরটা? সেই সৌরেন্দুকে মনে পড়ে? তোর সঙ্গেই তো বেশি বন্ধুত্ব ছিল...

অমিতাভ তখন সবে বলেছে, আরে কাল সন্ধেয়ই তো আমার...

কিন্তু অতনুর কথা শেষ হয়নি। এবং সে বক্তব্যের বাকি অংশটুকু বলে গেল এক নিশ্বাসে, গত শনিবার ভবানীপুরের ওদিকে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি কথাটা শুনলাম দেবব্রতর কাছে। দ্যাখ, আমাদের ব্যাচের একটা ছেলে চলে গেল। হ্যাঁ, কী বলছিলি যেন, কাল সন্ধে না কী...

অমিতাভর জবাব দিতে সময় লাগে। হাঁ করে চেয়ে থাকে খানিকক্ষণ অতনুর মুখের দিকে। কী বলবে ভেবে পায় না সহসা। তারপর আমতা-আমতা করে জোড়াতালি দিয়ে খাড়া করে জবাবটা, না মানে, ইয়ে, এই গতকাল সন্ধেবেলা, ঠিক এমনি সময়ই হবে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে আচমকা ওর কথা মনে পড়ছিল জানিস। একেবারে আচমকাই, বুঝলি। কেমন আশ্চর্য কো-ইনসিডেন্স বল! এতদিন পর কালকেই হঠাৎ ওর কথা মনে পড়ল, আর আজকেই...

এরপরে আর কথাবার্তা বেশি এগোয় না।

বাড়ি ফিরে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে অমিতাভ। অনেক পরে উঠে সামান্য ভাত-ডিমসেদ্ধ চাপায় হাঁড়িতে। মনে মনে হিসেব করতে থাকে, আজ বুধবার। গতকাল গিয়েছে মঙ্গলবার। সেখানে গত শনিবারই...

হাঁড়ির ভেতর তখন শুধু ভাত ফুটতে থাকার শব্দ ঘরময়।

তারপর অনেকদিন কেটে গিয়েছে।

সৌরেন্দু কিন্তু সেই সন্ধ্যায় যা বলে গিয়েছিল অক্ষরে অক্ষরে রেখেছে সেই কথা। অমিতাভ এখনও সারাদিন অফিসের কাজে ডুবে থাকে। প্রোমোশনও হয়েছে সম্প্রতি। দিনের বেলায় আর পাঁচটা লোকের থেকে তার জীবনধারায় কোনও তফাতই নেই। কিন্তু আজকাল রাতে বাড়ি ফিরে লাইব্রেরির বইতে আর মন বসে না বেশিক্ষণ। খেয়েদেয়ে ঘুমোতে চলে যায় বেশ তাড়াতাড়ি। প্রতি রাতেই স্বপ্ন দেখে ঘুমের ভেতর। তার সেই স্বপ্ন যতই দীর্ঘায়িত হয়, ততই তার মানসিক পরিতৃপ্তি।

শীতের দুপুরে স্কুল পালিয়ে দাদুর মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছে জয়ন্ত, সুজিত, সরু অমিত, দেবজিৎ, তন্ময়, পার্থ, বাপন, অমিতাভ, সৌরেন্দুর মতো অনেকেই। বিদ্যুৎ একটা ছয় মারল তো মাঠময় চিৎকার উঠল, শিউলি শিউলি। ওই নাইন এ-র জানলায় শিউলি। সুজিত পরের ওভারেই বোল্ড করে দিল বিদ্যুৎকে। পার্থ যদি একবার অমিতাভকে চার মেরে ব্যাট উঁচিয়ে কাত্যায়নীর দিকে তাকায়, তবে আর নিস্তার নেই তার। সেই ওভারেই অতনুর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যেতে হবে তাকে। অমিতাভ মুষ্ঠিবদ্ধ হাত হাওয়ায় আস্ফালন করাতে করাতে অকারণে কাত্যায়নীর দিকে বারকয়েক রাগত চোখে তাকাল। অতনু ক্যাচটা নিয়েছে ভাল...

গঙ্গার ধারে মক্কেশ্বর ঘাটের সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে আছে অমিতাভ আর সঞ্চিতা। গঙ্গার জলে বিকেলের রোদের আভা। সেই নিস্তেজ রাঙারোদই এসে পড়েছে সঞ্চিতার ফরসা গালে। হাসতে হাসতে বলছে সঞ্চিতা, আমার মনে হয় রাকেশ আর শাশ্বতীর মধ্যে কিছু চলছে...

বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে প্রায় আটটা হয়ে গেল। বারান্দায় পা দিতে না দিতেই মা বলে উঠল, তুই যে আমায় বলে গেলি অনির্বাণের বাড়ি যাবি, তা ওই তো এসেছিল এই একটু আগে। অমিতাভ সামলে নিল কোনওক্রমে, রাস্তায় জয়ন্তর সঙ্গে দেখা হল। ও বলল অনির্বাণ নাকি মামার বাড়ি গেছে। তাই আর অনির্বাণের বাড়ি না গিয়ে জয়ন্তর বাড়ি গিয়েছিলাম...

এমনি কত টুকরো টুকরো স্বপ্নেরা ভোররাত অবধি অমিতাভর ঘুমের ভেতর ভেসে বেড়ায়।

অমিতাভ আনন্দ পায় ওদের দেখে।


5 comments:

  1. গতানুগতিকভাবে শুরু হয়ে পাকে অয়াকে অভিনব ভাবনায় জড়িয়ে নেয়।

    ReplyDelete
  2. নিস্তরঙ্গ জীবনে ছোট ছোট তরঙ্গ দিয়ে গেল এই ছোট ছোট দেখা হয়ে যাওয়া। ভালো লেগেছে, গল্পটা। শুধু পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যবয়স্ক লোক বলে অমিতাভকে মনে করতে পারছিলাম না।‌

    ReplyDelete
  3. অতনুর সঙ্গে ঐ দিন সন্ধ্যায় দেখা হয়নি । অমিতাভের ভিতরেই ছিল ও। দায়দায়িত্বহীন জীবনে যে স্পেস থাকে সেখানে এসে জায়গা জুড়ে বসেছে । মনে পড়িয়ে দিল:স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা কঠিন; স্বপ্ন ছাড়া, কঠিনতর ।

    ReplyDelete