বাক্‌ ১৪৭ ।। মানস সরকার


 

                                                           

বৃষ্টির জন্ম

 

এই মুহূর্তে মাথা নীচু করে বসে আছে নারী। শোখোবুড়ো তাকে আদ্যোপান্ত পরীক্ষা করেছে। তার স্তনবৃন্ত যুগল, যোনিদেশ, তলপেট। বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সবশেষে চোখ দুটো। নারীর নজর এড়ায়নি, বুড়োর শ্বাস–প্রশ্বাস বেশ দ্রুতই পড়ছিল। যেন কিছুটা উত্তেজিত। কীসের উত্তেজনা আসলে! শোখোবুড়োই একমাত্র জানে, সমস্যা সমাধানের পথটা শেষ অবধি এসে মিশেছে এই নারীতেই নাকি নারীর দেহটায়! অধীর আগ্রহে কুঁড়ের বাইরেটায় গরানের (গ্রামের) সমস্ত লোক জড়ো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শোখোবুড়ো সমস্যা সমাধানের কী পথ দেখায়, জানার জন্য।

          টাঙিয়ে রাখা পাটের আড়ালে রামনি কথা বলে চলেছে শোখোবুড়োর সঙ্গে। ফিশফিশিয়ে চলা কথাগুলো সাপের হিসহিসানি মনে হচ্ছে নারীর। ফিশফিশানি বা হিসহিসানি যাই-ই হোক না— তার মধ্যে নারী ষড়যন্ত্রের আভাস পায়। তুম্মা যেদিন ওকে দখল করল, সেদিনও যেন এই ষড়যন্ত্রের শরীরী রূপ আর তার আস্ফালন দেখেছিল।

          শোলাব (বিবাহপ্রথা) অনুযায়ী তুম্মার বাবা ওর শরীরের পরীক্ষা করেছিল প্রথমে। শরীরের লক্ষণ দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিল। সেদিনই রাতের তিনপ্রহর অবধি তারপর তুম্মা ওর ওপর প্রবল উদ্দাম চালিয়েছে। যেন ঝড় হয়ে নেমে এসেছিল শরীরের উপর। এ কোন শরীর! অবাক হয়েছিল নারী, ক্লান্তি নেই কেন সে শরীরে! চার প্রহরে শোলাবের প্রহর ঠিক হয়। তার আগে সাজানো চলে কনেকে। নারীকে যখন সাজানো হচ্ছে, উল্লাস চলছে বাইরে, ভেতরে তখন ওর অসহ্য যন্ত্রণা, রক্তপাত। এরপর কেটেছে অনেক রাত। ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা প্রদীপের সলতের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে মিলিয়েছে নারীপ্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে শিখা নেভার সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় ওর অস্তিত্বও শেষ হয়ে যাবে। আসলে ওর অস্তিত্ব নিয়ে ততটা চিন্তা করতে চায়নি তুম্মা। সন্ধেরাত থেকে ভোররাত অবধি ওর শরীরকে প্রবলভাবে বিদ্ধ করে গেছে একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে। তার গরানকে বাঁচাতে হবে। বৃষ্টি নেই টানা দু’বছর। শস্য কমছে। তুম্মা এখন এ গরানের সহকারী মোড়ল। শোখোবুড়ো জানিয়েছে, নারীই একমাত্র পারে ওদেরকে এ বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে। কিন্তু তার জন্য ওই নারীর শরীরে তুম্মার শরীরও থাকতে হবে। বুঝেছে তুম্মা। ঘরের কাঠের দেওয়ালে বর্শার ফলা দিয়ে আঁকড় কেটে রাখত আর চাঁদের আকার দেখত। আর চলত, নির্দিষ্ট দিন অন্তর অন্তর নারীর যোনিদেশ পরীক্ষা। বেশ কিছুদিন হল সে যোনিদেশ দিয়ে কোনও রক্তপাত হয়নি। যেমনটা নিয়ম করে হয়। তুম্মা আকাশের দিকে দু’হাত তুলে আনন্দধ্বনি দিয়েছিল। আর এখন শোখোবুড়োর ঘরের বাইরে গালে দু’হাত দিয়ে অপেক্ষা করছে।

রামনির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ঘাড় নাড়ে শোখোবুড়ো। দৌড়ে বাইরে চলে যায় রামনি। ভেসে আসে হর্ষধ্বনি। স্থির হয়ে বসে আছে নারী। শোখোবুড়ো তাকে এগিয়ে এসে আর্শীবাদ করছে। তাকে কর্তব্যপালনের জন্য আহ্বান করছে। এ গরানের কোনও নারীর দ্বারা আগে যা সম্ভব হয়নি, এবার হবে।

নারী বুঝেছে সে কথা। শরীর দিয়ে। অন্তরের নির্যাসে সে কথার এতটুকু পরশ লাগেনি। অন্তরের বৈরাগ্যেই সে শরীর দিয়েছে বা নিয়েছে। শরীরের দেওয়া–নেওয়ার সম্পর্কের শত ভেদ্যতার মধ্যিখানেও অন্তরকে সে অভেদ্য রেখেছে। নারী, অন্তরকে বোঝে। নিজের অন্তর। এই অন্তরের সঙ্গে তার ভোগ্য শরীরকে শত যোজন দূরে রাখতে পেরেছে। শরীরে শরীর ধারণ করার অবকাশে সে নিজে আজ উপলব্ধি করেছে, শরীরের যে ফসল দিয়ে সে গরানের ফসল রক্ষা করবে, সে ফসল আর যাই হোক তার অন্তরের ফসল নয়।                              এখনও বসে আছে নারী। কারণ শোখোবুড়ো তাকে যেতে বলেনি।

          এগিয়ে আসে শোখোবুড়ো। তাহলে এবার পালিত হবে পরের ধাপের প্রথা। কপালে ওর লেপে দেওয়া হয় কাদা। বিড়বিড় করে কিছু উচ্চারণ করে চলেছে শোখোবুড়ো। একটানা। একসময় থামে। তার খোলা স্তনে চুমু খায়। তারপর বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। শোখোবুড়োর পেছনে পেছনে নারী।

দিন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গরানের মানুষগুলোর মধ্যে প্রবল উৎসাহ ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ নেচে ওঠে। বেশিরভাগ মানুষগুলোই আশায় বুক বাঁধছিল। সব থেকে বেশি খুশি হয়েছে বোধহয় তুম্মা। ঘনঘন ঘাড় নাড়ছে আর হাতের বর্শাটা মাটিতে ঠুকছে। বিদ্ধ হচ্ছে মাটিনারী জানত, শেষ অবধি তাকে হয়তো এটাই করতে হবে। তবুও তার মনে হয়েছিল, অন্যরকম কিছু হলেও হতে পারে।

নাঃ, নারী ক্রমশই নিশ্চিত হচ্ছে তার শরীর দিয়েই মেঘ ভেদ করে বৃষ্টিকে নিয়ে আসতে হবে। নারী শরীরে বৃষ্টিও নিজেকে একবার জড়িয়ে নিতে চায়। গরান বিশ্বাস করে, গর্ভবতী নারীর শরীরে বৃষ্টির আকর্ষণ বেশি। বৃষ্টি তখন আকাশে থাকতে পারে না। আর বৃষ্টিকে পেয়ে পৃথিবীর মৃন্ময়ী শরীর গর্ভধারণ করে। সন্তানসম শস্যকে ধারণ করে। ভূমিষ্ঠ করে। জঠরজ্বালা মেটে মানুষগুলোর...

“Naked I wait thy love’s uplifted stroke !

My harness piece by piece thou hast hewn from me,

And smitten me to my knee;

I am defenceless utterly.”

- Francis Thompson/The Hound of Heaven.

নারীর মনে একটা সন্দেহ ছিলই। তাও কাউকে সে প্রকাশ করতে পারেনি। সন্দেহটা ফলে গেলে অবশ্য কী হবে, তা ও জানে না। যেমন জানে না, ওকে যে কাজের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তা আদৌ ওর দ্বারা হবে কিনা।   সারা আকাশটা জুড়ে উজ্জ্বল রোদ। গোটা গরানের আজ যেন ক্ষিদে–তৃষ্ণা–রান্না–শিকার কোথায় উবে গেছে। মাকড়র পাহাড়ের ধারের তৃণক্ষেতে বসে আছে নারী। গরানের কাউকে সঙ্গে আসতে বারণ করেছে শোখোবুড়ো। তুম্মাকেও। অনেক দূরে একটা পাথরের ওপর লাঠিগাছটাকে নিয়ে বসে আছে বুড়ো। আর অবিরাম মন্ত্র পড়ে চলেছে দুলে দুলে। ক্ষেতের অনেক ঘাসই শুকনো। সবুজের কিছু রেখা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে মাত্র। এ গরানে এসেও নারী এ ক্ষেতকে পরিপূর্ণ দেখেছে। ক্রমশ ধূসর হচ্ছে— তৃণ, শস্যক্ষেত, ছোঁয়া লাগছে মানুষের পেটে, মস্তিষ্কে, আচারে, আচরণে...

দক্ষিণমুখো হয়ে নিজের পোশাক ধীরগতিতে খুলে ফ্যালে নারী। নিরাভরণ, উন্মুক্ত হয়ে যায়। নিজের তলপেটে একবার হাত বুলিয়ে নেয়। প্রাণকেন্দ্রের এই ভরকে স্থাপন করতে হবে প্রকৃতিতে। সেজন্যই এই খোলা আকাশের নীচে এ অবস্থায় তাকে নাচতে হবে। খুশি করতে হবে আকাশদেবতাকে, সূর্যকে ঢেকে দিতে হবে মিশকালো মেঘ নিয়ে। সারাদিন ধরে এ নৃত্যে যদি আকাশদেবতা খুশি না হন, তাহলে রাতে চন্দ্রদেবতার নীচে আরও একবার। আজ পূর্ণিমা। সূর্য অথবা চাঁদ— যে কোনও একজনকে মেঘে ঢাকতে পারলেই নেমে আসবে বৃষ্টি। প্রলোভিত করতে হবে বৃষ্টিকে। সবাই স্থির বিশ্বাসে বসে আছে। একমাত্র নারী-ই পারে। বৃষ্টি নামলেই ভরন্ত হবে গোলা, গরান, তাদের উদর। শুধু শিকারের ওপর নির্ভর করে গরানের মানুষজন আর পেরে উঠছে না। মাটির শস্যকণা চাই। অথচ দেখা নেই বৃষ্টির। পারে, পারতেই হবে... নারীকেই।

পাট দিয়ে বেঁধে রাখা চুলকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নারী। নৃত্যের প্রাথমিক পাঠ তার নিজের গরানের মায়ের মা-র কাছ থেকে। সে নৃত্য জাগিয়ে তুলত শিকার শেষ করে ফিরে আসা ক্লান্ত মানুষগুলোর শরীরও। মাঝরাত অবধি আগুন ঘিরে হই-হট্টগোলের পরে ফিরে যেত যে যার সঙ্গীনীদের কাছে। দেহসুখে মত্ত থাকত রাতভর। জীবনের পূর্ণতায় রাত একসময় ভোর হত।

ধীর পায়ে নিজেকে আন্দোলিত করে প্রথমে নারী। আস্তে আস্তে কানে ভেসে তার অজানা, অচেনা মিষ্টি এক সুর। দেহ এবার তার হিন্দোলিত। গোটা শরীরেই ছড়িয়ে পড়ছে স্বেদ। সে স্বেদকণায় তার শরীরে আরও জেদ আসছে। তাল তার দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। নিশ্বাসের স্পন্দনও। স্তনের গোড়া উত্তেজনায় তিরতির করে কখনও কখনও কেঁপে উঠছে। সে নেচে চলেছে। বৃষ্টি নামে তরলকে সে প্রলুব্ধ করছে। তার যোনিদেশে জেগে উঠছে এক অদ্ভুত স্পন্দন...

সময় কাটছে। নারীর গতি কমছে। শরীরের উত্তাপ ক্রমশই ক্লান্তিতে পর্যবসিত হচ্ছে। তবুও সে নেচে চলেছে। সময় নদী হয়ে প্রবাহ হতে থাকে।

বসে পড়ে সে।

তারপর তৃণক্ষেতে শুয়ে পড়ে। তলপেটে তার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে সে শোখোবুড়োকে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না। সারা শরীর জুড়েই যেন এবার তার দহন শুরু হয়েছে। উপরে তখনও গনগনে সূর্য। চোখ বুজে ফ্যালে সে।

পাহাড়ের ওপারে যেন একবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল মনে হল। চোখ চেয়ে নারী দেখার চেষ্টা করেদৃষ্টি ততটা এগিয়ে যায় না। নাকে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে বৃষ্টিগন্ধ। নিশ্চিত হতে পারে না সে। বৃষ্টির ফোঁটার অস্তিত্ব যদি সে কোথাও অনুভব করছে, তা হল তার চোখের কোলে...

11 comments:

  1. চমৎকার গল্পটি।

    ReplyDelete
  2. খুব সংহত বুনোন। বিদ্ধ করে।

    ReplyDelete
  3. নারীকে মহীয়সী করে তোলা সেও এক ধরনের ফাঁকি। গল্পের ভাষা, লেখনী ভালো লেগেছে। শেষের বিষাদ ছুঁয়ে গেল

    ReplyDelete
  4. অদ্ভুত ভাষা ও বলার কৌশল। পারে, পারতেই হবে... নারীকেই ।

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লাগলো মানস, দারুণ বুনন👌

    ReplyDelete
  6. গদ্যের ভেতরে তীব্রতা পাঠককে মোহিত করে।

    ReplyDelete
  7. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  8. অসাধারণ!!!! ভীষণ ভীষণ সুন্দর!!

    ReplyDelete