কার্ল কেম্পটন
কার্ল কেম্পটন (জন্মঃ ১লা জুলাই, ১৯৪৩) আজ আমাদের কাছে পরিচিত নাম।
অঙ্ককবিতা, দৃশ্যকবিতার বিশ্বে অগ্রগণ্য কার্ল লিখেছেন
শাব্দিক (Lexical) কবিতাও এবং সেখানেও অনন্য তাঁর উচ্চারণ, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতায়
একীভূত।
১৯৬৬-তে প্রথম কার্লের কবিতা প্রকাশিত হয়, তখন তিনি
সেনাবাহিনীতে।
বর্তমানে থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ার ওসিয়ানোয়, সঙ্গে জীবন ও
মননের ঘরণী রুথ। কবিতার পাশাপাশি
সূর্যমুখীর চাষ আর পরিবেশ আন্দোলন। এ পর্যন্ত ৪৫টি বই প্রকাশিত, অসংখ্য
অ্যান্থোলজিতে সংকলিত তাঁর রচনা।
কবির অনুমতিক্রমে তাঁর কয়েকটি কবিতা বাংলায়
অনূদিত হল।
...
কাকের পালক
[CROW
FEATHER]
ওঠানো ভুরু
পুরোনো চাঁদ
কাক ঘুরছে
কাকের জিভ
[TONGUE OF CROW]
নীল গম্বুজে
অপরাহ্ণ যখন গুটিয়ে নেয় নিজেকে
নীচে পিছলে-চলা মেঘের ভেতর
রুপোয় রং করে সমুদ্রকে
মাঝ বরাবর শীর্ণ পঙ্ক্তি
ধাতু-গলানো চুল্লির জিভ দিয়ে
কাক জলে-জলে ঝালাই চেটে নেয়
রং
[COLOR]
সব রং যোগ করলে কালো
সাদা, বিয়োগ করে পাওয়া
এক বিশুদ্ধি
এক অনুপস্থিতি
এক পরিহার
এমনকি অচৈতন্যের
মননক্ষেত্রে
তাপ শোষণের এক অনিচ্ছাও
এ তো সাদাকালোর বা সাদার
বা কালোর
কোনো প্রশ্ন নয়, উত্তরও
নয়
কারণ আলোর তো আছে নিজস্ব
আয়না
অন্তর-পুষ্পের
পরিপার্শ্বে
নির্মলতার তুলে-রাখা হাত
যে পথে অনন্তের মুহূর্তে
আগুপিছু ঊড়তে পারে কেউ
দার্শনিক
কাক
[PHILOSOPHER
CROW]
১-এর ছায়া যখন ২-এর ওপর
পড়ে
বেরিয়ে আসে ৩
অথবা
১ আর ২-এর ছায়া
পরস্পরের দূরে যেতে যেতে
একবার, দুবার স্পর্শ করে
ধারণ করে একে অপরের
কণা
যেন ১ আর ২-এর ছায়া
বানায় ৩ আআর ৩
যদি এটা আলোর ব্যাপার হত
আমরা পাত্তাই দিতাম না
তা তো নয়, শব্দ দিয়েই
বস্তুর গঠন
শব্দ আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি
এক
সর্বভুকের প্রাগিতিহাস
[PREHISTROY OF AN OMNIVORE]
ঘাসবীজ আর ফল খেতে খেতে কাক
খুঁজে পেল ঈশ্বরকে আর খেয়েও নিল
পড়ল ঘুমিয়ে তার সব ধ্যানধারণা আর আকাঙ্ক্ষা
ডানাদের নিয়ে গেল ঐতিহাসিক স্বপ্নে
শ্বাসরোধ আর সেই একটা কাশি আমি বিশ্বাস করি
রক্ষণশীল সৃষ্টিতাত্ত্বিকেরা একেই বিগ ব্যাং বলেন
যতক্ষণ না তোমায় গ্রহণ করি শ্বাসারোহণে
আমার বিষ্ঠা জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্বীকার করবে না
কোওটরা ছুঁড়ে দেবে রাত্রে আর চিটে
রইবে মাতামহীর নকশার চ্যাটচ্যাটে আঙুলে
[উত্তর আমেরিকার আদিবাসী সম্প্রদায় কোওট]
বাস্তুবিদ্যা
[ECOLOGY]
পূর্ণিমার চাঁদকে ঘষে উজ্জ্বল করে কাক
অমাবস্যার চাঁদকে ঠুকরে তীক্ষ্ণ করে
শোকের কালো বাজুবন্ধ থেকে কেটে
শিথিল করে রাত্রিকে
আত্মার বাস্তুতন্ত্রে
যেখানে ডানা বাতাসকে ঠেলে জাগিয়ে রাখে
আমরা এর ভার টেনে নিয়ে যাই অন্যদিকে
আমাদের দিকে যখন পাথর ছোড়া হয় মনে পড়ে এইসব
তন্ত্র
[TANTRA]
পুরুষের কেশরেখা নাভি থেকে
নীচে নেমে গেছে
মেয়েরা বলে গুপ্তধনের পথ
জীবনরহস্যের দ্বারে
সাদা কালি দিয়ে লেখে দৃঢ়
শেকড়
শরীরের সব কোশ এক পলের জন্য
সোনার হয়ে ওঠে
শূন্যতাকে ভরিয়ে ফিরে আসে
দ্রুত
হে মহাশয়া, আছেন প্রেমিক আরেক
আছেন তিনি অন্তরে আর হৃদয়ে
গেঁথে রেখেছেন শেকড়
হে মহাশয়, আছেন প্রেমিকা
আরেক
আছেন তিনি অন্তরে আর হৃদয়ে
ফুটিয়ে চলেছেন কুসুম
কাকের পালক
[CROW FEATHER]
আমাদের না-জানা যত বাড়ে
অভিধান আয়তনে
তত বড়ো হয়
রহস্যের
গান
[SONG
OF THE MYSTERY]
গ্রহণ-লাগা চাঁদের পিঠে
থাপ্পড় মারল উল্কা
কাশিতে সৌরবাতাসে
খোদাই-করা একটা পাথর বেরিয়ে এল
কাক স্পষ্টভাবে নেমে
একটা কাকতাড়ুয়ার হাতে কা
কা করছে
সকল স্বর একদিন পাথরে বন্দি হয়
বিষয়ে
[ABOUT OF]
আকাঙ্ক্ষার গর্ভে শব্দের ডিমের ভেতর
আলোর শুক্রাণু প্রবেশ করছে– সন্ধান
না পাওয়া পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানীরা
ঠিকঠাক গর্ভবতী হন না
আলোর স্ফুলিঙ্গ সযত্নে ভরিয়ে তুলে
তাঁরা শব্দের কণাগুলি
আকাঙ্ক্ষার জালে ধরতে পারেন
শিকার
ও সংগ্রহ
[HUNTING AND GATHERING]
তার জন্য নির্ধারিত রাত্রির অংশ খেয়ে ফেলল কাক
কালো থাকার জন্য সারাদিন
যা থেকে ধীরে ধীরে নিজের ভাগ খেয়ে নিয়েছে সে
গন্ধকের ধ্যান ধ’রে ভাঁটি থেকে
নিজেই নিজেকে তোলে উল-পাকানো সুর্যের বল
কাক তার বাসার জন্য
আলোকতন্তুদের মধ্যে থেকে টেনে নেয় অন্ধকার
নামকরণ
[THE NAMING]
১
কোথায় গেল শিখার ওপর ঘূর্ণমান চন্দ্র-সূর্যের
টানাপোড়েনে মধ্যরাত্রি
পাথরের ডাকে পরিচালিত
কে আত্মা মেঘ বীজ শব্দদের পাশে ছোড়ে
কোনও বুড়োর হাতে কাকের পালকে নিয়ন্ত্রিত
কেউ দেখে
সক্রেটিসের কথায়
আমি জ্ঞানের প্রেমিক
শহরের মানুষজন ছাড়া আর কিছু
আমাকে স্পর্শ করে না
গাছগাছালি, উন্মুক্ত প্রান্তর
তবু ঝুলন্ত ফলের পিছুপিছু গরু যেভাবে যায়
আমিও তোমাকে অনুসরণ করে
গ্রামাঞ্চলে যাব
যদি আমার সামনে ধরে রাখো একটি বই
২
যেভাবে আমরা ভাসি তাঁর অবলোহিত গানে
একদা কোনও মন গিলে রহস্য নাম দিল
অপর ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গিয়েওছিল দূরে
৩
যেরকম কাব্বালার অনুগামী আর অ্যালকেমিস্টরা
আলো দিয়ে লেখার কথা ভাবতেন
যেরকম রুমি একটি কাগজের কথা বলেছিলেন
যা থেকে বাতাস
শুধু এক রঙের নির্মলতা রেখে
উড়িয়ে নিয়ে যাবে শব্দদের
আর কবিরের থেকে টেনে নিয়ে একটি সুতো
বয়ন
যে-কোনও পবিত্র গ্রন্থে দেখো
পাশ থেকে
কিছু-না রয়েছে সেখানে
৪
ভাষার নতুন এলাকায় নেমে আসে কাক
নখ দিয়ে খুঁড়ে সে পোকামাকড় খুঁজে পায় –
অর্থের পেছনে অর্থ
মনের সব কিচিরমিচিরের নরম তলপেট
বয়ে নিয়ে মূর্ত করে জিভের নির্মাণশিল্প
শুধু শোনা-কথার সঙ্গে মোলাকাত হয় না
কাকের পালক
[CROW FEATHER]
কেবল বাড়ি থেকে পালানো জিভ-ওলটানো পাখিতে
ভাব থাকে সময়ের বাইরে আর সময়ের ভেতরে
বিশ্লেষণে বিবেচনায়
ঘটনা আর তাদের বাস্তবায়িত সান্দ্রতা
আগুপিছু তরঙ্গে পরস্পরকে ক্ষইয়ে দেয়
ঘাটতি
[WANTS]
পরিবেশবাদীরা পাহাড়টিতে ওকগাছ লাগাতে চায়
কিন্তু প্রথমে তাদের হৃদয়ে কি রোপণ করা উচিত নয় এক পবিত্র
উপবন
যেখান থকে বীজ নিজেনিজেই ছড়িয়ে পড়বে
পালকের কলম দিয়ে নাড়ানোর মতো যথেষ্ট ভারি বাতাস থেকে আমরা
সবাই মুক্তি পেতে চাই
অথচ বিশ্বময় পাম্প করে নির্মলতা ছড়িয়ে দিতে
আমাদের হৃদয়ে রাজত্ব করছে ক্যাথিড্রালের চার কুঠুরিতে
পবিত্র ধূপের আলোর প্রতি অনিচ্ছা
গুজব
[RUMOR]
একমাত্র কিছু-নাই পারে কোনওকিছুকে আড়াল করতে
এই কিছুনা নিজেনিজে ,যদিও, হৃদয়ের নির্মলতম বাহু
জড়িয়ে থাকে
এই সে শস্য নিগূঢ়ের কাঙ্ক্ষিতে দেখা যায়
যে কথারা, যেন ধীরে জিভ জড়িয়ে চিবিয়ে নিয়েছে
আমদের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়নি, নিজেদের মধ্যে
বিড়বিড় করতে করতে ফেলে গেছে ছায়া শুধু
আমাদের দুচোখের মাঝখান অস্থিতে
জোর করে ধরে থাকা তাদের বহু প্রশ্নচিহ্নে
আমরা কান লাগিয়ে রাখার চেষ্টা করি
তারাও এই গুজব শুনেছে –
চার শব্দের যোগ
কৃপা
সমর্পন
চরণ
ললাট
যা স্থূল চিন্তার এই অন্ধকারের তেতর
নীল আলোর বৃত্ত ফুটো করতে পারে
..
অনুবাদ: অনিন্দ্য রায়
পুরানো সেই যাদুচিরাগ এর মতো কবিতাগুলো যার গা ঘেঁষে ও ঘষে চললে আলো বিকিরণ করে মনের গহীনে।
ReplyDeleteআজকাল পুরনো অনেক কিছুই মনে করতে পারি না।
ReplyDeleteকার্লের কবিতাও মনে আসছে না। তাই এই অনুবাদে যেন নতুন করে জানলাম। কাক নিয়ে এতসব লিখে ফেলেছেন- ভাবা যায়! 'কাশিতে সৌরবাতাসে খোদাই-করা একটা পাথর বেরিয়ে এল' লাইনটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। অনুবাদের জোর ভালো লাগলো।
গুজব কবিতায় শুধু মনে হল এক বহতা। বাকিগুলো ছোট ছোট স্ট্রোকে দৃশ্য,অনুভব,এবং তার সঙ্গে শব্দ মিশেলে এক নতুন দরোজা দিয়ে যেন এক প্রান্তরে নেমে পড়েছি, যার দূরে এক বনরেখা,মাথার ওপর ঘূর্ণিমান দু'একটি কাক, যাদের ছায়া আমার আত্মাটুকরো নিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
ReplyDelete