জীবনের মধ্যে একটা
বিস্তৃত জগৎ নিয়ে চিন্তার বসবাস । লেখার জগতের চেয়েও যার বড় পরিধি । সমস্ত চিন্তা
লেখার ভাষায় পরিণত হতে পারে না । লিখিত ভাষায় চিন্তার কোন অংশ জায়গা পাবে তা একজন লেখকের
পক্ষে বলা খুবই মুশকিল । তার মূল কারণ, লেখকের নিজস্ব লেখাটিও ঐ চিন্তার মধ্যে
নিজের স্থান দখল করে বসে থাকে । লেখার অংশ ছাড়াও চিন্তার একটি অলিখিত অংশ থাকে । সেই
অংশটা ভাষায় পরিণতি পায় না, কিন্তু চিন্তার যে অংশটা লেখার
ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছে, সেই অংশের গঠনমূলক ক্ষেত্র
হিসাবে চিন্তার অপর অংশটা চিরকাল কাজ করে গেছে । ভারতীয় উপমহাদেশে সাহিত্য ও লেখালিখির
পিছনে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর একটা বিরাট জায়গা করে নিয়েছে । সেই পরিসরের সবটা
সামনে আসে না, কারণ লেখার ক্ষেত্রে একটা অর্থবহ আড়ালের ভীষণ
প্রয়োজন যা সম্পূর্ণ সত্যিটাকে পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরবে, অথচ সেই লেখাটির মধ্যে লেখকের নিজস্ব স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ন থাকবে । উপমহাদেশের
রক্ষণশীলতা একটা বিরাট ধরে যুগের সাহিত্যকে শাসন করে, আয়ত্তে
রাখে । বিখ্যাত সাহিত্যিক আঁদ্র জিদের লেখাগুলোর মধ্যে সমকামিতার যে স্বাধীন প্রয়োগগুলো
ছিল, ইংল্যাণ্ডের রক্ষণশীল সমাজ তা পাঠকের সামনে আনার জন্য
অনুমোদন দেয়নি । ফলে, বহুদিন সেইসব ফরাসি ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলো
ইংরাজিতে অনুবাদ হয়নি । শুধুমাত্র জিদ নয়, অস্কার ওয়াইল্ডের
লেখাগুলোকে ইংল্যাণ্ডের রক্ষণশীল সমাজ নিঃশব্দে এড়িয়ে চলত ।
জীবনকে আকর্ষণ করার মাধ্যমে যে লেখক তাঁর রচনাগুলোকে
ক্রমশ একের পর এক লিখে যায়,
জীবন তাঁকে চিনতে পারে বহুযুগ পরে । আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলোকে
পড়ার মধ্যে দিয়ে কতটুকুই-বা তাঁকে চিনতে পেরেছি । রবীন্দ্রনাথের
গভীরে ছিল লেখার বলয় । অনন্তের বিরুদ্ধে তাঁর সমস্ত চেতনাকে তিনি বিদ্রোহী করে তুলেছিলেন
মনে মনে । অবসরও তাঁর কাছে ছিল কাজের সময় । আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে আমাদের এই সময়ে
যাঁরা লেখালিখি কিংবা দর্শন চেতানায় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে, তাঁদের কাছে আবিষ্কারযোগ্য তেমন কিছু পড়ে নেই, যা দিয়ে আমরা তাঁদের সংস্কৃতির মধ্যে চিরকাল খুঁজব । ঠিক যেভাবে একজন তরুণ
লেখক সমস্ত প্রবীণ লেখকদের সঙ্গ দিলেও, শ্রদ্ধা করলেও,
একান্ত গোপনে সে পুজো করে রবীন্দ্রনাথের । রবীন্দ্রনাথ সেই আশ্রয়,
সাহিত্যে যাঁকে শুধুমাত্র 'গোরা'
বা 'শেষের কবিতা' দিয়ে বিচার করা যাবে না । তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকেও লেখালিখি ও দর্শন শিক্ষার
একটা জায়গা আমরা পাই ।
বিশ্বসাহিত্যের
কনটেক্সটে যদি রবীন্দ্রনাথের লেখাকে দেখি, তবে বলব রবীন্দ্রনাথ ইবসেনীয় ট্র্যাজেডিতে
লিখতেন । শেক্সপিরিয়ন ট্র্যাজেডিতে বহু লেখক লিখেছেন পৃথিবী জুড়ে । কিন্তু শেক্সপিয়র
আসার আগে লেখকেরা লিখত গ্রিক ট্র্যাজেডিয়ানদের পথ মেনেই । এমনকি গ্রিক ট্র্যাজেডিয়ান ও নাট্যরচয়িতা
সফোক্লিস, ইউরিপিডিস ও এসকাইলাসের ট্র্যাজেডির ওপরেই দাঁড়িয়ে
আছে শেক্সপিরিয়ন ট্র্যাজেডি যা মৌলিক দিক থেকে অ্যারিস্টটলের ধারণাকৃত । বছর আটেক যখন
পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হই, তখনও পর্যন্ত লেখালিখির দুনিয়ায়
একটা পরিশ্রমসাধ্য জায়গা ছিল । স্মার্টফোনের লেখার প্রচলন সেসময় খুব একটা আসেনি । অনলাইন
বাংলা পত্রিকায় সর্বপ্রথম সাড়া জাগায় 'বাক্' । যেসময় অনেক পত্রিকা ছাপা অবস্থায় প্রকাশ পাচ্ছে, সেইসময় 'বাক্' শুরু করল
ওয়েবজিন । আজও 'বাক্' তার কাঠিন্য
নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । 'বাক্' সেই পত্রিকা
যে একজন প্রতিষ্ঠিত কবিরও খারাপ লেখা ফিরিয়ে দেয়, একজন নতুন
কবির ভাল লেখাকে গ্রহণ করে । এরকম বহু কাগজ একসময় ছাপা হত, যা ছাপতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন সম্পাদক, তবু
কবি বা লেখককে তিনি আর্থিক ব্যাপারে কথা দিয়ে কথা রাখেননি এমন হয়নি । আবার এমনও হয়েছে
অনেক সম্পাদক লেখা নিয়ে আর্থিক প্রতিশ্রুতিরক্ষা তো দূরে থাক, লেখা ছাপিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট লেখক বা কবিকে জানাননি পর্যন্ত । বুদ্ধদেব বসু
সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের লেখা ছাড়া সকলের লেখাই ফিরিয়ে দিয়েছেন একবার করেও । সংশোধিত
লেখা গ্রহণও করেছেন । এবং, কী কারণে লেখা অমনোনীত হল তা চিঠি
দিয়ে জানিয়েও দিতেন। সেসব চিঠি বই আকারে প্রকাশ পেয়েছেও, আবার
অনেক লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থেকে গিয়েছে । মাইনের টাকা থেকে অনেক তরুণ কবির বইও
পর্যন্ত প্রকাশ করেছিলেন । তাঁর পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হলে কবির ঠিকানায় চিঠি ও খামে
করে কিছু নগদ আসত (স্বল্প হলেও) ।
বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে লেখার মান বিচারে মনমালিন্য হয়েছে জীবনানন্দের, সমর সেনের, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের, প্রেমেন্দ্র মিত্রের এবং আরও অনেকের । তবু, এঁদের
লেখা বুদ্ধদেব ছেপেছিলেন । এঁরাও লেখা দিয়েছিলেন । কবি শঙ্খ ঘোষের লেখাও তিনি একবার
ফেরৎ দিয়েছিলেন । শঙ্খবাবু সম্ভবত আর কোনও লেখা বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায় পাঠাননি । এগুলো
কিছু না, এগুলো হল নিষ্ঠা ও সৎভাবে কাজ করার নিদর্শন । সাহিত্য
যে প্রচারের জিনিস নয়, জনপ্রিয়তার জিনিস নয়, খ্যাতির জিনিস নয়, বরং বলতে গেলে সাহিত্য যে একটা
সামাজিক দর্পণ, একটা ভাষার বিপ্লব, একটা সময়ের নির্ভরযোগ্য অবস্থান, একটা বিরাট সৃষ্টির
দায়িত্ব, এই মানুষগুলোর কাজ সেটা প্রমাণ করে ।
তখন
সাহিত্য পত্রিকাগুলো সাধারণ মানুষ কিনে পড়ত । এখন লিটিল ম্যাগ কিনে পড়ে মূলত সাহিত্যের
সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই,
যারা নিজেরা লেখে । আর পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা,
যারা সাহিত্য পড়ার পাশাপাশি সাহিত্যের গুণগতমান সম্পর্কে আলোচনাও
করে । কিন্তু সাধারণ পাঠকদের সিংহভাগটাই সরে গিয়েছে বাণিজ্যিক কাগজের দিকে । কারণ,
'৮০-'৯০ দশকের পর বিজ্ঞাপণ ও পণ্যসভ্যতার
আগমন সাধারণ বাঙালিকে বাণিজ্যিক পত্রিকামুখী করে তুলল । অন্যায় নয় এটা, কারণ কোনও সংস্থা সাহিত্যের প্রতি উদ্যোগী না হলে একা সম্পাদক এই দুর্মূল্যের
বাজারে কী করে নিজের টাকায় পত্রিকা চালাবেন, কবি বা লেখকদেরই
কীভাবে উপার্জন হবে ? কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বাণিজ্যে বসতে লক্ষী কাগজেরা সাহিত্যকে বাজারিকরণ
করে রাখতে গিয়ে বিশ্রি মানের করে তুলল । সূচীপত্রে যাঁদেরকে দেখা যেতে লাগল তাঁদের
লেখায় ক্রমশ সাহিত্যমূল্য শূন্যতে নামতে থাকল । সাধারণ মানুষের পছন্দ-অপছন্দের লেখাই সেইসব বাণিজ্যিক পত্রিকার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল । ফলে এ
যুগে পৌঁছে বিরাট নির্মাণ নিজেকে গা ঢাকা দিল । কিছু বছর আগেও শারদীয়া সংখ্যাগুলোতে
লেখালিখি নিয়ে একটা আলোচনা শোনা যেত । আলোচিত হত উপন্যাসগুলো । আজকাল সেসব স্তব্ধ ।
বরং, যে গভীর বইগুলো বাঙালি পাঠক এতকাল দূরে সরিয়ে রেখেছিল
সেগুলো নিয়েই আলোচনা করছেন জনপ্রিয় লেখকরা । প্রশ্ন হচ্ছে তাঁদের নিজেদের সৃষ্টি কোথায়
যাচ্ছে । আনন্দ, দেজ, সহ অন্যান্য
বড় প্রকাশনারও বেশ কিছু ভাল কাজ আছে । দেখা যাচ্ছে দিনের শেষে সেগুলো পড়ে আছে,
কিন্তু গড়পড়তা মানের বইগুলো বিক্রি হয়ে গেছে । পাঠকের কাছে সাহিত্যের
মূল্যবোধ কিন্তু পৌঁছচ্ছে না । পৌঁছচ্ছে না বলেই, আজ কেউ কেউ
একথা বলে, 'দেখুন, বুদ্ধদেব বসু,
সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, বিনয় মজুমদার সবাই বোঝে না । তার চেয়ে যদি মানুষ শ্রীজাত-বিনায়ক-অংশুমান পড়ে তৃপ্তি পায় তো ক্ষতি কী
!' 'প্যারডাইস লস্ট' সম্পর্কে এ সময়ের একজন
কবির মতামত ছিল, 'আজকের দিনে নাকি মিলটনকে লোকে পড়ে না ।'
এ
যুগে একজন কবির যদি এই মতামত হয় একটা বিশ্ববিখ্যাত উঁচুদরের সাহিত্য সম্পর্কে যে বইয়ের
গুণগ্রাহী ছিলেন শেক্সপিয়র,
এলিয়ট, ইয়েটস্, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বরা,
তবে তাঁর সঙ্গে আমি সাহিত্যবিষয়ে আর কী আলোচনা করব ? স্যাটানের চরিত্রকে তো তিনি বলে বসবেন অলৌকিক রচনা ।
শনিবার
কলেজস্ট্রিট কফিহাউসে চাঁদের হাট বসে সন্ধেবেলায় । কতবার গিয়েছি । ২০১৬ থেকে যাওয়া
বন্ধ করেছি । সাহিত্যের চেয়ে দলতন্ত্র বড় হয়ে যাচ্ছিল সেখানে । ফেবারিট কেবিন, বসন্ত কেবিন,
কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, ক্যান্টিন,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর কফিহাউস,
কাফে কবিরা, চাঁদনি চকের কফিহাউস,
সর্বত্রই বিছিয়ে এই দলতন্ত্র । সেই হিংসা ওয়েবজিনেও এসে পড়েছে ।
রিপোর্ট করা, লিঙ্ক উড়িয়ে দেওয়া, ইত্যাদি তো আছেই । সঙ্গে আছে দু'কলম লিখে অহঙ্কার
জাহির করা কবিদের ঔদ্ধত্য । কেউ ভুল ছন্দে লিখে চলেছেন, তার
সেই লেখার নিচে যখন প্রতিষ্ঠিত কবিদের একাংশ উৎসাহ দিয়ে চলেছেন । অথচ, ঠিকটা শেখানোর দায়বদ্ধতা মনে করছেন না । আবার সেই তরুণ কবি দিব্যি মঞ্চে
উঠে আওড়ে যাচ্ছেন সেইসব লেখা যাতে ছন্দ বানান সহ একাধিক ভুল থাকছে । সেই লেখা যখন
নিজের কবিতাপাঠের ছবি সহ ফেসবুকে দিচ্ছে সেখানে ধরা পড়ছে তার ভুলগুলো । সংশোধনের শিক্ষা
মানুষ অনেকদিন পায়নি । পরিশ্রমের পথও ত্যাগ করে হয়ে উঠেছে সুযোগসন্ধানী । তা হলে বড়
সাহিত্য তাঁদের হাতে হবে কী করে ? যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার
পায় দেরিতে, যোগ্যতমের হাত দিয়ে আসে সেই পুরস্কার । আমার নিজের
যে লেখাগুলোকে আমি কেটে ফেলি, পুড়িয়ে ফেলি, বাজে বলে বাতিল করি, দেখি তার চেয়েও বাজে,
নিম্মমানের লেখা প্রকাশ পাচ্ছ বই ও কাগজের পাতায় । তখন আমি আমার ভাল
লেখাগুলোকে নিয়ে একটা আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হই যে আমি নির্বাচিত হয়েছি যুগের কর্তব্য
সাধনে । এবং, ভাল লেখাগুলোকে আমি আরো ভালোর দিকে নিয়ে যাই
যাতে নিজেকে মর্ত্যলোকে থাকাকালীন বুঝিয়ে যেতে পারি আমি জনপ্রিয় নই, আমি দৃষ্টান্ত । জনপ্রিয়তা থেকে দৃষ্টান্তে পৌঁছতে গেলে যে মূল্য দিতে হয়,
সাহিত্যে আমার জীবন সেই মূল্য দিতে প্রস্তুত । আমি লিখব না সেই লেখা
যা পাঠক চাইছে । আমি লিখব সেই লেখা, যা পাঠক প্রয়োজনের তাগিদে
খুঁজে নিয়ে পড়বে । আমার তো দরকার নেই প্রচুর পাঠকের । স্বল্প পাঠকই আমাকে পড়ুক বুদ্ধিমত্তার
তাগিদে, মনের একাগ্রতা নিয়ে । যে স্বল্প মানুষেরা আমায় পড়ে,
তাঁদের প্রত্যেকেই প্রায় কবি লেখক । আমার লেখার মধ্যে যদি কিছু থেকে
থাকে তো বিচারধারাই আমাকে বহন করছে ও করবে ।
এতক্ষণে
এ ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমি যুগের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারি না । অর্থাৎ ন্যায়নীতির
জায়গায় একটা তফাৎ আছে । এটা যদি তফাৎ হয় তো তফাৎ, যদি ব্যর্থতা হয় তো ব্যর্থতা,
কিন্তু যাই-ই হোক, এটা থাকাটা জরুরি । স্বার্থপরের মতো জনপ্রিয়তা নিয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ
করে একদিন চলে যাব বললেই কি যাওয়া যায় ? উত্তরাধিকারসূত্র
সাহিত্যে কী অবদান রেখে যাচ্ছ তা একদিন মানুষ জানতে চাইবে । সেদিন তো জানাজানি হয়ে
যাবে আসলে তুমি সাহিত্যিক হিসাবে নিজের মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছিলে কিনা লিখতে এসে !
(ক্রমশ)
আমি জনপ্রিয় নই, আমি দৃষ্টান্ত- অমূল্য একটা শোনলাম। লেখার ভেতর দিয়ে আত্মমর্যাদাবোধ, ধৈর্য্য এবং সততার যে ছায়া পেলাম- মনে থাকবে। আপনি লিখেছেন বুদ্ধদেব কেন লেখা ফিরিয়ে দিয়েছেন সেসব নিয়ে বইও প্রকাশ হয়েছে, নামটি জানতে পারি?
ReplyDelete