বাক্‌ ১৪৭ ।। শ্যাম পুলক

 


মনসামঙ্গলঃ বিজয়গুপ্তের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ভাবনার প্রসারণ ও উদযাপন

 

স্বপ্নপর্যায়

একদা বাসলী দেবী এক যুবকের স্বপ্নে উদয় হলেন। তিনি তাকে তাঁর মাহাত্ম্য কীর্তন ও পূজা প্রচারের জন্য কবিতা লিখতে বললেন।

দিন যত যেতে থাকলো, একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলো। তবে তা এক যুবকের কাছে নয়। একই সময়ে নয়, বা একই অঞ্চলে নয়। উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশ—সবখানেই একই স্বপ্ন মানুষের ঘুমে ভাসতে লাগলো। অবশ্য সবার স্বপ্নেই একই লক্ষ্য নিয়ে বাসলী দেবী উদয় হলেন।

এবং যারা স্বপ্নে দেবীদর্শন লাভ করলেন, তারা কবি হলেন। তারা দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন ও পূজা প্রচারের লক্ষ্যে কাব্য লিখতে লাগলেন। তখন তাদের কবিতায় বাসলী দেবী কখনও পদ্মাবতী হিসেবে, কখনও মনসা হিসেবে, আবার কখনও বা বিষহরি হিসেবে উদ্ভাসিত হতে লাগলেন।

একদা বাসলী দেবী কবি বিজয় গুপ্তের স্বপ্নে উদয় হলেন। তিনি তাকে তাঁর মাহাত্ম্য কীর্তন ও পূজা প্রচারের জন্য কবিতা লিখতে বললেন। যতো দিন যেতে লাগলো ততোই একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগলো। কিন্তু যদি কেবল তার সময় নিয়ে থাকা যায়, তবে তার পদ্মাপুরাণের সময়ের বিস্তার আমাদের সামনে ভাসতে থাকবে।

কিন্তু স্বপ্নপর্যায়ে কি কোনো প্রশ্ন করা সম্ভব?—হয়তো সম্ভব। স্পষ্টভাবেই সময়কে রূপকথায় ডুবিয়ে দিচ্ছে না। তাছাড়া স্বপ্নের চিরন্তন ভাবনা যখন আসে, তখন ঘুম ভাঙলেই হয়তো প্রশ্ন আসে। কিন্তু, কেন কবিরা প্রায় তিন শতাব্দি জুড়ে একই স্বপ্ন দেখতে লাগল? কেনো একই স্বপ্নাদেশ পেতে লাগল?

অবশ্য মনে হয় না, স্বপ্নপর্যায়ে এ প্রশ্ন করা সম্ভব—কবিরা আসলেই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিল কিনা? এটা কি এমন, তারা বাল্মীকির দ্বারা অতিমাত্রায় অনুপ্রানিত? কিন্তু বাসলী দেবী সরাসরি তাদের জাগ্রত যাপিত বাস্তবতায় তাদের সামনে আসতে সম্মুখীন হননি। কারণ সময় অনেক বৃদ্ধ হয়েছে। ফলে চতুর্থ-পঞ্চমমাত্রার অস্তিত্ব এখন আর সেই অর্থে সম্ভব না।ফলে কবিদের কাছে আসার জন্য স্বপ্নই দেবীর একমাত্র পথ ছিল।

এবং কবির স্বপ্নে দেবীর পুরো কাহিনী ব্যক্ত হয়। আর কবি যখন সকালে উঠে আসন পেতে লিখতে বসেন, তখন নিরন্তর উদযাপন শুরু হয়। তবে কাহিনীর উদযাপন না হয়ে, স্বপ্ন বা আবেগ তথা বোধের উদযাপন হয়।

তখন তা প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে, কিন্তু যা আসলে নতুন প্রশ্ন। যেমন, ঠিক কোন ঐতিহাসিক সত্য আসলে কিম্ভূতকিমাকার রূপ লাভ করে? তা কি এমন, যা কোনোভাবেই নির্দিষ্ট দ্বান্দ্বিকতা সীমাবদ্ধ নয়, আপেক্ষিক? তা এমনকি নির্দিষ্ট সময়েও সীমাবদ্ধ নয়। কারণ অবশ্য অস্তিত্বের বহুমাত্রিকতা। এবং তা মোটেই কেবল পদার্থবিদ্যার তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়। স্বপ্ন ও কল্পনায় উদযাপিত। এবং সেই স্বপ্ন ও কল্পনা, যাপিত জীবনে যেমন শক্তি ও ক্ষমতার ক্রমবিকাশের ধারার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, এগিয়ে নেয়,  একইভাবে তারাও নিয়ন্ত্রিত হয়। হয়তো রূপ ও অলঙ্কার সেই প্রবাহকে ধারণ করে। আবার সেই রূপ ও অলঙ্কারই আসলে উদযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে বা শক্তি দান করে। এবং তা কবির উদযাপনকেও শক্তি দিয়েছে।

কেউ যখন কবির কাব্যে রূপক ও অলঙ্কার খোঁজে, কোথায় খোঁজে? অথবা কোন অনুষঙ্গ খোঁজে?—কিন্তু যতক্ষণ স্বপ্নের ভাষা না বুঝে, ততক্ষণ কিছুই ঠিক উন্মুক্ত হয় না। তখন তারা কেবল ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে তৃপ্ত থাকতে চায়। এবং তারা তাতে সুখও খুঁজে পায়। এমনকি কখনও অনুতপ্তও হয় না। এটা অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো। একইসাথে শক্তি ও ক্ষমতার বিকাশের ধারার স্রোত বদল হিসেবেও তার সান্ত্বনাযাপন সত্য হয়ে ওঠে। তখন শেষে আসলে আর কিছুই করার থাকে না। তারা শব্দ চষে বেড়ায়। ভাষা বিশ্লেষণ করে। শেষে ফসলের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে। তখন স্পষ্টই-ই তারা ঠিক কী চায়, তা তাদের সামনে ভাসতে থাকে।

জন্ম হতে শোক পর্যায়

যন্ত্রণা, শোকের ক্ষমতা ও প্রভাবের নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। আদি কবির প্রথম শ্লোকের কথা ভাবা যেতে পারে। নিষাদ গোষ্ঠীর পরাজয়ের নিশান বাল্মীকির চোখে স্পষ্টভাবে ভেসেছে। এবং সঙ্গমরত হরিণের যন্ত্রণা যখন কবির শোক হয়ে ব্রহ্মার কাছে নিবেদিত হয়েছে, ব্রহ্মা তখন তাকে শোককে উদযাপনের বিজয় কাহিনী একই ধরণের শ্লোকে লিপিবদ্ধ করতে আদেশ দিয়েছেন

এটা সেই সময়ের হতে পারে যখন সম্রাট অশোক মহান হয়ে উঠছেনবুদ্ধের দর্শনে নিজেকে নিবেদন করে, সকল জীবে দয়া করতে শুরু করেছেন। ফলে বহু শিকারজীবী নিষাদেরা তার শোকের কারণ হয়েছে। তখন বনে হরিণসহ পশুপাখি শিকার নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

অবশ্য মনসার জন্ম থেকেই তাঁর শোক শুরু। পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে পাতালের নাগালয়ে লালিত।পরে যৌবনে পিতা কর্তৃক লাঞ্ছিত। তবে তারপর ক্ষণকাল সুখে কাটলেও সৎমা পার্বতীর বঞ্চনা, শেষে পিতা কর্তৃক নির্বাসন তাকে শোচনীয় অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। পতির অবহেলা ও পরিত্যাগ সেই অবস্থাকে আরও করুণ করে তুলেছে। কিন্তু তাঁর শোক তাঁর কাছে শক্তি হিসেবে ধরা দিয়েছে। যা তাকে পৃথিবীতে তাঁর পূজা প্রচারে অনুপ্রেরণা দিয়েছে ও শক্তি জুগিয়েছে। ফলে পরে চাঁদ সওদাগর কর্তৃক তিনি যতবার-ই বঞ্চনা ও প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়েছেন, কোনো কিছুই তাকে তাঁর লক্ষ্য থেকে পিছপা করতে পারেনি। তিনিবারবার পরাজিত হয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এবং অনিরুদ্ধ উষার অপহরণের মতো সব ধরণের অসাধ্য কাজ সাধন করেছেন। পরে বেহুলা লখ্যিন্দর হয়ে তাদের নবজন্ম সূচিত হয়েছে। বেহুলার ত্যাগ তিতিক্ষায় শেষে মনসার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। অবশ্য তার শোকের শক্তিতে সনকার শোক, বেহুলার শোক, ছয় নববধুর শোক, কমলার শোকও যোগ হয়েছে।

আর বিজয়গুপ্তের শ্রোতাদের সবাই সবকিছু জানে। প্রথমেই তিনি কী কী ঘটবে সব ব্যক্ত করেছেন। এমনকি কীভাবে ঘটবে তাও অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। এখন কেবল প্রতিক্ষণ তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। ছন্দ ও সংগীতের শক্তি একটা ঘোর সৃষ্টি করবে। এবং সবাই সব জানে, কিন্তু আবার কিছুই জানে না। তারা কী ঘটবে, তা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকছে।

অবশ্য এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। পুনরাবৃত্তি খণ্ড খণ্ড হয়ে নতুন নতুন চক্র হয়ে অনেকটা উপবৃত্তাকার পথে ঘুরবে। এটা স্পষ্ট যে সেই উপবৃত্তাকার পথেরও পুনরাবৃত্তি ঘটবে। শোতারা তা শুনবে যা শুনেছে। তা জানবে, যা জেনেছে। কিন্তু নতুন রূপ ও অলঙ্কার তাদের নতুন সময়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই সময় একই তুমুল প্রাচীন ও চেনা।

ব্রহ্মা বাল্মীকিকে বলেছিলেন, যেহেতু তোমার শোক থেকে এর জন্ম, অতএব এর নাম শ্লোক হোক। কিন্তু রামের শোক উদযাপনের ভঙ্গি হয়তো কেবলই যুদ্ধ নয়, যা শ্লোকে লিপিবদ্ধ হতে থেকেছে। আর যদি রাম বা সীতার শোক উদযাপন তাদের পুত্রের মাধ্যমে হয়, তবে তখন বেশ স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে, কী পেতে চাচ্ছে। কিন্তু রামের শোক ও মন্দভাগ্য উদযাপনে যুধিষ্ঠির কতোটা সান্ত্বনা পেয়েছিল, অথবা রামের শোক যুধিষ্ঠিরের শোকে কতোটা অর্থপূর্ণভাবে যুক্ত হয়ে তাকে যুদ্ধে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করেছিল, তা ক্ষমতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে হয়তো নবরূপ উন্মাদনা দিয়েছে। অবশ্য পাণ্ডবদের দুর্ভাগ্য ও শোকের আসলে ঠিক শেষ নেই। তা-ই অবশ্য তাদের চরম যুদ্ধে এবং বিজয় উদযাপন ও মন্থনে নিয়ে যায়।

তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে আমাদের সবসময়েই এমন একজন দরকার হয়, যারা বিভীষণ, যারা মীরজাফর, এবং সেখানে ক্ষমতা শুদ্ধ ও পবিত্র। যেখানে সিতার অপহরণ কেবল যৌনতার অনুষঙ্গ। একইভাবে বিজয়গুপ্তের কাছেও বেহুলার অস্তিত্ব শোকের থেকে যৌনতার অনুষঙ্গ হিসেবে উদযাপিত হয়েছে। এমনকি সে যখন ভেলায় একা মৃত স্বামী নিয়ে ভাসছে, তখনও যৌনতার রূপ ও প্রভাব কাব্যে গতি দিচ্ছে। একইসাথে তা বেহুলাকেও গতি দিচ্ছে। তখন মনসার ভান ও ক্ষমতার খেলা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এজন্য হয়তো আধুনিক রাজনীতিতেও স্ক্যান্ডালগুলো জনপ্রিয় ও জরুরী হয়ে ওঠে। কারণ তার যেকোনো কিছুকেই সরল ও অকৃত্রিম করে তোলার ক্ষমতা আছে। এমনকি তখন মিথ্যেগুলো আরও দ্রুতগতিতে সত্য হয়ে ওঠে। ফলে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার মন্থন তখন আরও সহজ হয়। যা বিজয় গুপ্তের উদযাপনেও স্পষ্ট হয়েছে।

এবং রাজনৈতিক ইতিহাস বা বাস্তবতায় পুজা বা ক্ষমতার প্রসারণে যখন প্রতিনিয়ত শোকের উদযাপন ও মন্থন স্পষ্ট হয়, তখন ঠিক কেনো তা ঘটবার জন্য শক্তি খরচ হয়? বা যখন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রতিনিয়ত তার শোক, ব্যক্তিগত শোক প্রকাশ ও তার শোকের ইতিহাস বলতে থাকে, তখন সে কি সেই ইতিহাসে মানুষের বিচরণ প্রত্যশা করে, যেভাবে বিজয়গুপ্ত চেয়েছে, যাতে মনসার ব্যক্তিবিশেষকে অত্যাচারের ইতিহাসও শোকসংগীতে বিলুপ্ত হয়েছে, ভেসে গেছে? অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই মনসা গঙ্গার কাছে গিয়ে আশ্বাস বাণী নিয়ে এসেছেন। আর তা বিজয়গুপ্ত এমনভাবে তার কাব্যে গেয়েছেন যে, এটা স্পষ্ট—একই পুনরাবৃত্তির ইতিহাস এখানেও দৃশ্যায়িত হবে।আর ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা স্পষ্টই তাঁর ক্ষমতা ও শক্তিকে উদযাপন করবে।

এমন, কেবল মেরে ফেলাই না, বাঁচিয়ে তোলার ক্ষমতাও তার আছে। তিনি কেবল সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়েই দেবেন না, ভাসিয়েও তুলবেন। একইভাবে ক্ষমতার অধিকারীদের হাত ধরেও মেরে ফেলা ও বাঁচিয়ে তোলার আশ্বাস নিয়ে স্ক্যান্ডালগুলো ব্যবহৃত হয়তিনি পূর্ণ উদ্যমে বলে ওঠেন, কেবল জীবন দেয়া না, জীবন নেয়ার ক্ষমতাও তার আছে। একইসাথে তার শোকের পাহাড় উদযাপিত হয়, শান্ত হয়, নীরব হয়, মন্থিত হয়।

ফলে শিব কর্তৃক মনসাকে ডাকা হবে। লখ্যিন্দরকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব তার হাতেই অর্পিত হয়। কারণ এভাবে ক্ষমতার উদযাপন না হলে, চর্চার স্বাধীনতা পায় না। তখন তিনি এক ও অনন্য হয়ে ওঠেন। একইভাবে যেকোনো দেশের সরকারপ্রধানএক ও অনন্য হয়ে ওঠেন। তার কথা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তিনি সব ধরণের কাজের দায়িত্ব নেন। এবং তার নির্দেশেই সব ধরণের কাজ হয়।

অভিযোগের তাত্ত্বিক বিচার

কিন্তু চাঁদ সওদাগর তার মানব অস্তিত্ব কতোটা গুরুত্ববহ করে তুলতে পারলেন, এ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ধরা দিলো। তখন অভিযোগ শুরু হলো যে, দেবীর মহিমার চাপে সওদাগর পুরো কাহিনীতে অনেক প্রভাব ও শক্তি দেখালেও শেষপর্যন্ত বিজয় গুপ্ত তাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। কিন্তু আবার যখন তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হয় যে শেষপর্যন্ত তিনি আসলে জীবনের জয়গানই গেয়েছেন, তখন তা সবচেয়ে লোমহর্ষক হয়ে ওঠে। দেখা যায়, সকল অভিযোগই অচেনা অজানা ভাষায় উপস্থিত হয়। তাছাড়া একই সাথে মনে হয়, দিকে দিকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয়েছে। এবং মানুষ কী বলবে, কী অভিযোগ করবে তা দূর দূর থেকে সমুদ্রের বাতাসে ভেসে আসছে। সপ্তডিঙা মধুকরকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু তাকে ভাসিয়ে তোলা হয়েছে। এবং যে ডুবিয়ে দিয়েছিলো, যে ভাসিয়ে তুলেছে তার শক্তি ও ভাষার স্রোতে সেটা এগিয়ে আসছে।

কিন্তু সাহিত্যিক নান্দনিকতা ঠিক যেভাবে উদযাপিত, যেখানে আলো ও ছায়া ছন্দ ও অলঙ্কার বিচারে রূপের অর্থ অন্তর্মূখী না হয়ে নিরন্তর অস্তিত্বের দ্বান্দ্বিক প্রবাহ, তখন যে অর্থ বা ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়, তা কীভাবে স্পষ্টভাবে ও অকৃত্রিম শক্তিতে চেপে বসতে পারে, এবং টিকে থাকতে পারে? তার শক্তি ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতা কোথায়, যা আমাদের স্থবির হতে দেয়, যেখানে প্রস্তরযুগ পর্যন্ত নিরন্তর চলমান?

একদা এক যুগ ছিলো, যখন তত্ত্ব নয়, মানুষের ওপর গল্প চেপে বসত। এবং সেসব গল্প অলৌকিক জাদুশক্তিতে মানুষের ওপর চেপে বসতো। আর এখন যখন শক্তি চেপে বসার যুগ আসে, তখন কোনো গল্প চেপে না বসে, সেই গল্প নতুন ভাষা দান করে। যার মধ্যে ট্র্যাজেডির নির্বচ্ছিন্ন প্রবাহ বর্তমান থাকে। গল্প থেকে এখন সরাসরি তার ভিতরকার শোকই শক্তি হিসেবে কর্তৃত্বের যুগকে শক্তি দান করে। ক্ষমতা তখন ত্যাগ, যন্ত্রণা, শোকের খণ্ড খণ্ড অংশকে উদযাপন করে, উপভোগ করে। একইসাথে সবচেয়ে মহান শক্তি হিসেবে দেশ ও কালকে উজ্জীবিত করে। কিন্তু সময় যতই যেতে থাকে দেশ ও কাল গল্প হয়ে যেতে থাকে। সেই গল্প রূপকথার তত্ত্বে এগিয়ে চলে। এবং রূপকথাকে ডেকে আনে। ধীরে ধীরে দেশ ও কাল যে শক্তিকে পূজা করে, সেই শক্তি—জীবন রূপকথা হয়ে যায়।

কিন্তু এখানে কেবল কাহিনীকে টেনে আনা না, বিজয়গুপ্তের সাহিত্যিক সৃষ্টিশীলতায় যা সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তা অবশ্যই দেবদেবীকে জীবনের শক্তিতে টেনে আনা। তবে এটা এখানে বিচারযোগ্য যে, সেই জীবন যাপনে দেবদেবীরা তাদের দেবরূপকে কতোটা লোপ করতে পেরেছেন। সেখানে শিবের জীবনযাপন থেকে চাঁদ সওদাগরের যাপিত জীবন কতোটা মানবরূপ লাভ করেছে, তার সহজ ও নান্দনিক রূপতত্ত্ব বিজয়গুপ্ত কতটা স্বাভাবিক করে দিতে পেরেছেন, তা মনসার শক্তিতত্ত্ব থেকেও অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু সেটা এমনভাবে এগোয় না যে, তাকে সহজ অর্থে জীবনের জয়গান বলা যায়, যা কবিকে অতিমাত্রায় সংকীর্ণ করে তোলে। সেটা তার ওপর চাপিয়ে দেয়াই হয়। এবং সেই ভাষার প্রসারণ কোনোভাবে সৃষ্টিশীল না, অতিমাত্রায় ক্ষমতার দাম্ভিকতা ও চাপিয়ে দেয়া।

দেশ ও কাল সেই ভাষা রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ থেকে লাভ করে। অথবা এভাবে সরাসরি বলা যায়, রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের স্তর তাদের প্রয়োজনবোধে ভাষা ও তার অর্থদ্যোতকতা চাপিয়ে দেয়। এবং প্রয়োজনবোধে একই জয়গানের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। অথবা একই রাজনৈতিক স্তরের পুন-আগমন ঘটে তা হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। সেই স্থবিরতা তখন অন্য সব কিছুকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাতে তাদের সাপেক্ষ্যে নিজেকে স্থির স্থবির মনে হয়। তখন তার স্থবিরতা এক মহান শিল্প হয়ে ওঠে, যা অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তি লাভ করে বা লাভ করে বলে মনে হয়। কারণ, সে সেই রকমভাবে ব্যবহার শুরু করে। সে জানে, সে এক অনন্য, এবং আর কোনো স্তর নেই। একইসাথে, তাকে ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও এই।

আর যখন প্রশ্ন আসে, বাসলী দেবী নিজে কতোটা মানবরূপ লাভ করতে পেরেছে, তখনও আশ্চর্য অভিযোগ আসে যে, বিজয়গুপ্ত সেখানে মানবিক শোক ও হতাশা দেবীর রূপে স্পষ্ট করতে পেরেছেন। কিন্তু যেখানে সেই শোক ও হতাশা অনেকটা ঐশ্বরিক ও রূপক। তবে দেবীর মধ্যে মানুষের যে ঐশর্য প্রকাশিত, তা অসহায়তা। কিন্তু সেই অসহায়তাও ঐশ্বরিক অলৌকিকতায় অতিরঞ্জিত হয়েছে। এবং বেহুলা এক্ষেত্রে তার দুর্ভাগ্যের শোধ নিয়েছে। সে যখন শিবের সভায় যায়, তখন নৃত্যের মাধ্যমে তার সর্বোচ্চ ক্রোধ উদযাপিত হয়েছে।

কিন্তু যখন বিজয় গুপ্ত এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, পিতার খামখেয়ালি ও দুর্বলতাই কন্যার সকল দুর্ভোগের ও শোকের একমাত্র কারণ, তখন ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, যা আসলে পড়ে দেবীকে দুর্বলদের সহায় করে তোলে। কিন্ত যেভাবে মনসার এক ধরণের চিরায়ত অস্তিত্ব বহুকাল ধরে এখানে ছিলো, যাতে বস্তুবাদী নির্বচ্ছিন্ন ধারা সুনির্দিষ্টতায় আক্রান্ত ছিলো না, যার ওপর পিতৃত্ব ঐশ্বরিক খামখেয়ালি ও মহামারী হিসেবে চেপে বসেছে, তাতে ক্ষমতার ভোগকারী হিসেবেও মনসা ভিন্নরূপ লাভ করেছে। যা আধুনিক রাজনৈতিক শিল্পে নবীনরূপ লাভ করে, যখন রূপকথা ফিরে এসে স্থির হয়ে যায়।

তবে বিজয় গুপ্তের তথা সমকালীন কবিদের  সেই ব্যর্থতা যা মনসাকে, তিনি যা হয়ে উঠেছেন, তা করে তুলেছে, তা-ই তাকে আধুনিক শিল্পরূপে প্রবেশ করতে শক্তি দিয়েছে। যাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ক্রমবিকাশের ইতিহাস আরও সরলভাবে ফুটে উঠেছে, এবং মানব জীবন যাপনে প্রসারিত হয়েছে। তখন আধুনিক শিল্পরূপে ঐশ্বরিক অলৌকিকতার বিচরণ সেই ইতিহাসকে প্রতিনিয়ত মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। পিতার খামখেয়ালি ও পিতার সাথে কন্যার দ্বন্দ্ব ও সম্পর্ক এমন এক আবেগপূর্ণ সময়ের জন্ম দিয়েছে, যা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উদযাপনকে সবকিছুকে স্থবির করে দিতে প্ররোচিত করেছে। যদি এমন হয়, মানুষ আসলে স্বপ্ন দেখছে না, কারও স্বপ্ন হয়ে উঠেছে, তখন মানবসৃজিত শিল্পরূপ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু শেষে দেখা যায়, কোনোভাবেই অভিযোগ করা সম্ভব হয় না।

মনসার শিল্পরূপদৌরাত্ম্যের ক্রমপর্যায়

দেবী মনসা লখ্যিন্দরকে জীবিত করে ফিরিয়ে আনলেন। তার ছয় ভাইকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেন। সপ্তডিঙা মধুকর ফিরিয়ে আনলেন। এমনকি শত্রু কিন্তু বন্ধুর স্বামী ধন্বন্তর ওঝাকেও ফিরিয়ে আনলেন।কিন্তু সেখানেও বিজয়গুপ্তের দৃষ্টিতে পিতার খেয়ালি মানসিকতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে দেবীর জন্য পরে যখন পৃথিবীতে পুজা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তাঁর সফলতাও ঠিক তাঁর সফলতা হয়ে ওঠেনি। পূর্বের মতই তিঁনি পিতা দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন তাতে তাঁর দৌরাত্ম্যের ইতিহাস কেবল কবির মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছে। এবং তা আসলে চাঁদ সওদাগরকেই জয়ী করে তুলেছে। তা অবশ্য অবাস্তব হেঁয়ালি।

কিন্তু মনসার ব্যর্থতা ও লাঞ্ছনার মূলে ঠিক কী অবস্থান করেছে?—এটা কি এমন, দৌরাত্ম্যের শিল্পরূপে তাকে একমুখী করে তোলা হয়েছিলো? এবং পিতার সরল খামখেয়ালি ও প্রভাব আসলে কবির হৃদয়ে দেবীর স্বপ্নাদেশ থেকেও মূখ্য হয়ে থেকেছে; সেখানে দেবীর অস্তিত্ব ও মাহাত্ম্য থেকেও কাব্য চর্চার মূলে ভিন্ন স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে; এবং তা-ই তাকে সবচেয়ে করুণভাবে ব্যর্থ করে তুলেছে;যাতে দেবীর নিছক চূড়ান্ত দৌরাত্ম্যের রূপ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে;এবং পূজা প্রতিষ্ঠা হলেও, তা-ই তাকে সবচেয়ে দুর্বল ও করুণ করে তুলেছে?

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আসলে দেবীর ভরাডুবি হয়নি। যেমন, কমলা, বেহুলা, বা সনকার সাপেক্ষে তার অস্তিত্ব। এমনকি তিনি তাদেরই সবচেয়ে বড় সর্বনাশের কারণ হলেও, তিনি তাদের যে শক্তি দান করেছেন, তা বিজয় গুপ্তের দৌরাত্ম্যেও ধ্বংস হয়নি, নিজেদের রক্ষা করেতে পেরেছে। অবশ্য এটা দ্বান্দ্বিক ও প্রশ্ন সাপেক্ষ্য যে, পিতার সনাতন চিরতরুণ খামখেয়ালি ও ক্ষমতার আড়ালে সেটা নিজেদের প্রকাশ না করে পিতার ক্ষমতাকেই প্রকাশ করেছে কিনা। যা কেবল দেবীকে না, কবিকেও আসলে ব্যর্থ করে তুলতে পারেআর এই জন্য চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে আহাজারি করার তাত্ত্বিকদের এখনও অভাব পড়ছে না। আবার একইসাথে চাঁদ সওদাগরের অস্তিত্বে ও অটল পৌরুষে গর্ব করার মতো তাত্ত্বিকেরও অভাব নেই। তাদের সবচেয়ে উদ্ভাবনী মন্তব্য এই যে, সওদাগরের মাধ্যমেই এই কাব্য সবচেয়ে বেশি মানবিক হয়ে উঠেছে। অবশ্য সেই মানবিকতা স্পষ্টভাবেই পুরুষের মানবতত্ত্বে মন্থিত।

আবার এভাবে বলা যায়, একসময় মনসার দৌরাত্ম্যে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিলো। কিন্তু তখন তিঁনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেনযার মাধ্যমে তিনি তাঁর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নতুন ভান মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এবং সেই ভানের প্রথা অবশ্যই তাঁর নিজের উদ্ভাবন নয়। তা তাঁর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। একইভাবে তিনি তাঁর দৌরাত্ম্যে এক ধরণের নতুন অকৃত্রিমতা মেনে নিয়েছেন। ফলে শেষপর্যন্ত তিনি যা হয়ে উঠেছেন, তা তাঁর চিরন্তন সত্য নয়। তিনি অতিমাত্রায় শিবের লাঞ্ছিত বঞ্চিত কন্যা, বাসুকীর বোন বা স্বামী কর্তৃক অবহেলিক অসহায় নারী হয়ে উঠেছেন। এমনকি নেতার অস্তিত্বও তাকে দুর্বল করে তুলেছে।

একটা সময়ের পর দেবী মনসা নিজের থেকে বড় কোনো প্রতিপক্ষ পাননি। কবি এখানে চেষ্টা করলেও, পার্বতীকে ততোটা শক্তিশালী করে তুলতে পারেননি। সেখানে নারীত্ব সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে। আবার শিব অনেক বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দিলেও পিতৃত্ব তার অস্তিত্বকে অনেক বেশি দ্বান্দ্বিক ও অসহায় করে তুলেছে। তারপরও তার অস্তিত্বই আসলে বাসলী দেবীকে ধ্বংসের জন্য স্থির। চাঁদের মাধ্যমে তিনি কেবল নিজের এক প্রতিরূপ সৃষ্টি করেছেন।কিন্তু সেখানে শিবের দ্বন্দ্বটা স্পষ্ট। কারণ তিনি কেবল এমন নয়, মনসার ধ্বংস চাচ্ছেন, এমনকি দেবীকে নিজের করে নিতে চাচ্ছেন। তার পিতৃত্ব জন্মলাভ করেছে ভয় থেকে। হয়তো সেই ভয় তাকে হাজার বছর তাড়িয়ে ফিরেছে। কিন্তু এবার তিনি ভয়কে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়েছেন। বাসলী দেবীকে নিজের ছায়াতলে নিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছেন। কারণ তিনি দেবী মনসার ভয়টা পড়তে পেরেছেন। আর তাতে নেতার জন্ম তার কাছে আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে। আর নেতা-ই তার জন্য বাল্মীকির বিভীষণ হয়ে উঠেছে। তাতে ধীরে ধীরে বাসলী দেবী নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন তাছাড়া ক্ষমতার বিকাশের দিক থেকে শিবের অস্তিত্ব ও মনসার অস্তিত্ব মানুষের সাপেক্ষ্যে এক ও অনন্য হয়ে উঠেছে।

এবং এই প্রশ্ন-ই সবচেয়ে হতাশাজনক হয়ে ওঠে, আসলে-ই কি মনসার কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব ছিলো?—কিন্তু বিজয় গুপ্ত কতোটা স্পষ্টভাবে তার স্বপ্নের আড়ালে দেবীকে দৈব করে ফেলতে পেরেছেন? এবং তার ভয় কী? অসহায়তা কী? তখন তিনি কোন অর্থে রাজনৈতিক অসহায়তা যাপন করেছেন? সেখানে কতোটা নির্লিপ্তভাবে বাল্মীকির রাজনৈতিক অসহায়তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে?

তবে বাল্মীকি রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। তা অবশ্যই হয়তো অশোকের কৃতিত্ব। কিন্তু বিজয় গুপ্ত বলতে গেলে সেই সময়টা যাপন করেছেন। এবং বাল্মীকির থেকে বিজয় গুপ্ত গভীরভাবে তার স্রোতের বিভিন্ন দিক উদযাপন করতে পেরেছেন। কারণ ততোদিনে স্রোত বহুমুখী সাপের আচরণ করেছে।

সমাপ্তিপর্যায়ঃ- সময়ের ভবিষ্যৎ ভাবনা

ধরা যাক, স্বৈরাচারী আছে, মহামারি আছে,—এখন মানুষের কী দরকার?—যুদ্ধ, মন্বন্তর!

আর ভবিষ্যৎ কল্পনায় কী সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে?—রূপকথার মৃত দ্বান্দ্বিকতা যা স্বেচ্ছাচারী হিসেবে প্রকাশ পায়? বলা যায়, পুনর্জীবন লাভ করে। যেই ভয় বুদ্ধকে আসলে খেয়েছে, কিন্তু খ্রিস্টের শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বেহুলা না যতোক্ষণ তার পূর্বজন্মের দেবীত্ব সম্পর্কে না জানে, ততোক্ষণ তার ভবিষ্যৎ স্থির হয়ে যায় না। কিন্তু বিজয় গুপ্ত আসলে সেই ঝুঁকিটা নেননি। তিনি বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ সবকিছু নিজের হাতে সাজাতে চেয়েছেন। এর কারণ হয়তো একই ধরণের কার্যক্রম তিনি নিশ্চিতভাবে উদযাপন করতে দেখেছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, রাজনৈতিক ঐতিহ্য কীভাবে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতকে নিজের মতো করে অঙ্কন করে নেয়। আর স্পষ্টভাবে কবি হিসেবে বাল্মীকির প্রভাব চিরতরুণ ছিলো। যিনি রাজনৈতিক শক্তিকে তার সৃষ্টিশীলতার শক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন। একইসাথে বহুমুখী রাজনৈতিক স্রোত তাকে বেশ দ্বান্দ্বিক করে তুলেছে। ফলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে একটা নির্দিষ্ট ভবিষ্যতে নিজেকে স্থির রেখেছেন। ফলে ব্রহ্মা তার গল্পের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত অঙ্কন করে দিয়েছেনকবির সামনে ব্রহ্মা এক রূপকথা উন্মোচন করেছেন। আর কবি বাল্মীকি তার মধ্যে সময়কে ঢেলে দিয়েছেন

একইভাবে বিজয় গুপ্তও সময়কে দিয়ে বাসলী দেবী কর্তৃক প্রাপ্ত রূপকথায়প্রবাহদান করেছেন এই জন্যই হয়তো শেষপর্যন্ত অগ্নিপরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদি বাল্মীকির মতো বিজয় গুপ্তও সেটাকে অবহেলা করেও। ফলে সময় তথা রাজনৈতিক সময় (আতঙ্করূপ ধারণ করে)শিল্প ও সৃষ্টির সবচেয়ে বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছে। আর সেই সৃষ্টি ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠি তৈরি করছে। এবং তখন শিল্প যখন শিল্পের জন্য হয়েছে, তখনও তা ক্ষমতার জন্য হয়েছে। আবার শিল্প যখন মানুষের জন্য হয়েছে, তখনও তা ক্ষমতার জন্যই হয়েছে। আর তখন যে আশ্চর্য প্যারাডোক্সিক ডিলেমার জন্ম হয়েছে, তা যেন সেই প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের ওপর চেপে বসেছে এবং তার থেকে মানুষের মুক্তিলাভ হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষ অবশ্য বিজয়সংগীতের মাধ্যমে শোক উদযাপনে অভ্যস্ত। আর বিজয় গুপ্তকে সবচেয়ে দ্বান্দ্বিক মনে হয়, এ কারণে যে তিনি কেবল দৌরাত্ম্য নয়, ব্যর্থতাকে উদযাপনের ভঙ্গি উদ্ভাবন ও মেনে নিতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষে আসলে কেউ ব্যর্থ হচ্ছে না। এমনকি চাঁদ সওদাগরও না। চাঁদ সওদাগরের ব্যর্থ না হওয়ার কারণ, ততদিনে সময় বদলে গেছে। তাছাড়া তার অবস্থা এতোটা শোচনীয় হয়ে উঠেছে যে, তাকে আর জাগিয়ে তোলা সম্ভব না। হয়তো বিজয় গুপ্ত নিজে তার সেই শোচনীয়তার পথ অঙ্কন করেছেন। এটা অবশ্য তার বিজয় উদযাপনকেই কেবল সহজ করে তুলেছে।

এখন, সময়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে যখন চিন্তা করতে যাবো, তখন সোনালি যুগের আগমন ও একইসাথে শোকের উদযাপন মানুষের সৃষ্টিশীলতার একটা দিক উন্মোচন করে যা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষকে স্থবির অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাশালী করে। তখন ক্ষমতার উদযাপন এমন মহামারী হয়ে ওঠে, যা চিরন্তন মন্বন্তরে মানুষকে ধাবিত করে।

এমনকি বিজয়ের উদযাপন মানুষকে স্থবির করে দিতে পারে। কারণ তা সময়কে স্থির করে দেবার ক্ষমতা রাখে। এটা এ কারণে হয় যে, তা সবসময় রূপকথাকে ডেকে আনে। রূপকথায় স্বৈরাচারী অর্থদ্যোতকতা এতটা স্পষ্ট যে, তাতে যতো ইচ্ছা অর্থ চাপিয়ে দেয়া যায়। এবং তার ধারণ ক্ষমতাও অসীম। যা নিয়ে তাকে কখনই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। কারণ প্রশ্ন সেখানে কোনো গুরুত্ব বহন করে না।

আর এটা বলা যায়, সৃষ্টিশীলতায় ভবিষ্যৎবাণী সম্ভব। কিন্তু তা কেবল বর্তমানকে নির্দেশ করে। বর্তমানের অর্থ বহন করে। হয়তো এটাও বুঝায় যে, বর্তমান কতোটা নিয়ন্ত্রিত। সোনালি যুগ ফিরে আসলে বা সোনালি যুগ সৃষ্টির চেষ্টাও একইভাবে বর্তমানকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। মানুষের যাপিত জীবনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে একটি নিয়ন্ত্রিত জীবন উপহার দেয়।

৫৩২০, ঢাকা।


1 comment:

  1. চুম্বক টান, পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল। আপনার ভাবনা, রিসার্চ, লেখনী- সব মিলেমিশে অনবদ্য। পাঠক হিসেবে আমি তৃপ্ত

    ReplyDelete