বাক্‌ ১৪৭ ।। অনুপম বলছি

 

কয়েক মাসের একটা দীর্ঘ বিরতির পর 'বাক্‌' আসছে। 'বাক্‌ ১৪৭'। এই বিরতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। অজস্র ওয়েব পোর্টাল আর অনলাইন পত্রিকার ভিড়ে আর চিল-চিৎকারে 'বাক্‌' কোন পথ নেবে, সেটা ভাবার জন্য আমার সময়ের দরকার ছিল। অবশেষে 'বাক্‌' আসছে। আসার মতো করেই আসছে। 'বাক্‌' কোনোদিনই কবিদের ভ্রাতৃসঙ্ঘের মধ্যে নিজেকে রাখতে চায়নি। আজও তার পথ একক এবং বাকি সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন। 'বাক্‌'-এ লিখতে হলে সেই লেখাকে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। 'বাক্‌ ১৪৭'-এর জন্য প্রায় শতাধিক জন কবিতা পাঠিয়েছেন। তাঁদের ধন্যবাদ ও প্রেম জানাই। কিন্তু এটাও জানাই, কবিতা পড়ার অধিকার সবার থাকলেও লেখার অধিকারটা সবার আছে বলে 'বাক্‌' স্বীকার করে না। খুবই অল্প কয়েকজনের লেখা বেছে নেওয়া হল। তাঁদের কেউ কেউ পরিচিত মুখ, কেউ কেউ এই প্রথম কবিতা লিখলেন।

 

বাংলা সাহিত্যের জগতে কারা ঘোরাফেরা করছে? যারা কবি, লেখক, সম্পাদক, সমালোচক, প্রকাশক ইত্যাদি গালভরা পরিচয় নিয়ে বসে আছে, তাদের বেশির ভাগের আসলে পাঠক হওয়ার যোগ্যতাটুকুও নেই। ভান, ভান, আর ভান। এরা পড়তেই শেখেনি, কিন্তু এরা লিখতে এসেছে, আবার নাকি অন্যদের লেখাতেও এসেছেহ্যাঁ, এরা জোটবদ্ধ, যূথবদ্ধ। কিন্তু সেটা কেবল নিজের নিজের ক্ষুদ্রতাকে জোটের মধ্যে আড়াল করার জন্যই।

 

এরা না শিক্ষিত, না মূর্খ। এরা না ইতর, না অভিজাত। এরা না সভ্য, না অসভ্য। এগুলোর কোনো একটা না হলে একজনের লেখার অধিকারটা জন্মায় না। কিন্তু এরা সাহিত্যিক পরিচয়টা চায়। কেন চায়? কারণ এদের মধ্যে আছে আত্মপ্রতিষ্ঠার অচেতন প্রাকৃতিক লীলা, আর যেহেতু লিখতে পয়হা লাগে না বাওয়া। এর মধ্যে যখন সত্যিই কেউ লিখতে আসে, এবং এরা টের পায় সে অধিকার নিয়ে এসেছে কিছু লেখার, তার জোরালো আকাঙ্ক্ষা আছে কিছু করার, সে এদের কমপালসারি টার্গেট হয়ে যায়। আড়ালে প্রকাশ্যে এরা তার পেছনে লেগে যায়। এই রীতি আজকের নয়। আজ থেকে ১০০ বছর আগেও এই রীতি ছিল। এরা রবীন্দ্রনাথের জিনা হারাম করে দিয়েছিল, এরা জীবনানন্দ দাশকে ট্রামের তলায় পাঠিয়েছিল।

 

ফলে আমাদের সমাজে একজন প্রকৃত লেখকের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় এই ছদ্মলেখকদের প্রতিরোধকে অতিক্রম করা, এদের ‘সমালোচনা’ নামক বিষাক্ত তির এবং নীরবতা নামক ফাঁদগুলোকে পেরিয়ে যাওয়াএদেশে বইয়ের আলোচনার আরেক নাম অকুণ্ঠ স্তুতির মাধ্যমে প্রমোশন। আর সমালোচনা বলতে বোঝায় স্পয়লার আর কৌশলে একটা লেখাকে ধ্বংস করার চেষ্টা, যাতে সেটা পড়ে আর কেউ বইটা না কেনে (অর্থাৎ সমালোচনা = নিন্দা)‘সমালোচনা’ শব্দটার মানেই দাঁড়িয়ে গেছে নিন্দা। আর লেখক সেটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই বলে দেওয়া তিনি নাকি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। আরে তুই আগে সমালোচনা শব্দটার অর্থ তো শেখ! একটা বইকে পড়ার ভান না করে সত্যি করে পড়তে তো শেখ! নীরবতা আরেক অস্ত্র, সেটা ব্যবহৃত হয় লেখককে হতাশ করে দেওয়ার জন্য, তারা সবই পড়বে কিন্তু সাড়া দেবে না, আপনার কবিতায় একটা লাইক দেওয়ার চেয়ে বরং হাতটা কেটে ফেলে দেবে।

 

লেখকের সে এক অভিযান বটে। একজন কবিকে বাঙালি লেখক সমাজে একজন অভিযাত্রী হতে হয়, যেন নরখাদকদের গ্রাম পেরিয়ে তার নৌকো চলছে, আর নৌকোর তলায় ছ্যাঁদাযারা তার সঙ্গে আছে, তাদের হাতের দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। তারা সঙ্গ নিয়েছে তাকে ব্যবহার করবে বলেই। ছুরিগুলো সাময়িকভাবে লুকোনো আছে। যথাসময়ে বেরিয়ে আসবে।

 

                                                                      অনুপম মুখোপাধ্যায়

                                                               পরিচালক- বাক্‌ অনলাইন